দুই দিন আগে দেশে সংক্রমণ লাখ ছাড়িয়েছে। এই সংখ্যার মধ্যে মৃত্যুর তথ্য যেমন আছে, তেমনি আছে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা। সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই বেড়ে চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির প্রক্ষেপণে বলা হয়েছিল, জুনের শেষে মোট সংক্রমণ বেড়ে ১ লাখ ২৩ হাজারে পৌঁছাবে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষ হতে হতে আক্রান্তের সংখ্যা ওই অনুমিত সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেমন সফলতা দেখাতে পারেনি, তেমনি কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় নানা সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে। সাধারণ রোগী বা নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসা নিয়েও নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এসব সমস্যা দূর করার কোনো কার্যকর উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।
করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো হিসাব বা প্রক্ষেপণ মিলছে না। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বমুখী। এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, এমন ধারণা করা হচ্ছে।’
এই প্রক্ষেপণ বা রোগতাত্ত্বিক পূর্বাভাসের সঙ্গে যুক্ত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য বলেছেন, জনমিতি, আবহাওয়া, সংস্কৃতি, রোগতত্ত্ব, ভৌগোলিক অবস্থানসহ আরও কিছু বিষয়সংশ্লিষ্ট তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কিছু শর্ত সাপেক্ষে বিশেষ গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রক্ষেপণ করা হয়। কিন্তু শর্তগুলো পূরণ হচ্ছে না, তাই পূর্বাভাস মিলছে না। প্রক্ষেপণ করার সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল, মানুষ মাস্ক পরবে, একটি নির্দিষ্ট সময় সমাবেশ ও চলাচলে বিধিনিষেধ থাকবে, কলকারখানা বা অফিস–আদালতসহ স্কুল–কলেজ বন্ধ থাকবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি দেওয়া ওই প্রক্ষেপণে বলা হয়েছিল, জুনের শেষ নাগাদ সংক্রমণ কমে আসবে। জুলাইয়ের শুরু থেকে জনজীবন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সেটি হচ্ছে না।
সেবার ঘাটতি আছেই
সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রথম ধাপের কাজ হচ্ছে রোগ শনাক্ত করা। সেই কাজ এখনো ঠিকভাবে হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রোগী শনাক্ত করার ল্যাবরেটরির সংখ্যা তারা বাড়িয়ে ৬১টিতে উন্নীত করেছে। এর মধ্যে ৩১টি ল্যাব ঢাকায়, ঢাকার বাইরে ৩০ ল্যাবরেটরি। সরকার দেশের সব জেলায় ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে পারেনি। ময়মনসিংহ বিভাগে দুটি ল্যাবরেটরি কাজ শুরু করেছিল। ২০ দিনের বেশি জামালপুরের ল্যাবরেটরিটি বন্ধ। অন্যদিকে বরিশাল বিভাগে মাত্র একটি ল্যাবরেটরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার তথ্য দিচ্ছে। গতকাল শনিবার বলেছে, এ পর্যন্ত ৪৩ হাজার ৯৯৩ ব্যক্তি সুস্থ হয়েছেন। একজন মানুষ সুস্থ হয়েছেন বলে বিবেচিত হতে হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুবার নমুনা পরীক্ষার ফল ঋণাত্মক হতে হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এঁদের সবার সেই পরীক্ষা করছে না। হাসপাতাল থেকে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
>সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। তবে সংক্রমণ প্রতিরোধের সব পথ বন্ধ হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
কোভিড–১৯ রোগীদের একটি বড় অংশের আইসিইউতে রেখে চিকিৎসার দরকার হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সারা দেশে কোভিড–১৯ রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা আছে ৩৯৯টি, এর মধ্যে রাজধানীতে ২১৮টি। কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীতে আইসিইউ শয্যা আছে ১৪০টি। অন্যদিকে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ সংকট তীব্র। অধিকাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ৩০টি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা উন্নত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে নন-কোভিড রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছেন না—এমন অভিযোগ নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে বেশ সমালোচনা হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর কোনো সমাধান করেনি।
কী পরিস্থিতিতে আছি
করোনা পরিস্থিতি কী বা কোন পর্যায়ে আছে—তিনজন জনস্বাস্থ্যবিদকে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল। অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, পরিস্থিতি ভালো বলার কোনো কারণ নেই। সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বমুখী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনস্বাস্থ্যবিদ বলেছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি খুব খারাপ এটা বলা যাবে না। দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখের কিছু বেশি। মোট জনসংখ্যার তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কম। তবে বর্তমান সময়ের মতো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে পরিস্থিতি মারাত্মক খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, দিন দিন রোগী বাড়ছে। রোগী বাড়ার গতি এখন মাঝারি। কাজে শৈথিল্য দেখালে রোগীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যেতে পারে।
সমস্যা কোথায়
সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যা করার কথা ছিল, তা কি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সরকার করেছে—প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকে জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিষয়ে কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব দেশ এসব পরামর্শ অনুসরণ করেছে, তারা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনেকটাই উপেক্ষিত হয়েছে। মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সংক্রমণের গতি কমতে হবে। এর জন্য যে সক্ষমতা থাকা দরকার, স্বাস্থ্য বিভাগে তার ঘাটতি আছে।
দিন যত যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামর্থ্য ও দক্ষতা নিয়ে তত প্রশ্ন উঠছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দক্ষতার সঙ্গে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার কাজটি ঠিকমতো করতে পারেনি। এখন রোগ শনাক্তকরণের যে তথ্য তারা দিচ্ছে, তাতে গরমিল পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় ও বিতরণে যেমন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে, তেমনি করোনার জন্য বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় করতে না পারার তথ্যও পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ইকবাল আনোয়ার বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অর্থসংক্রান্ত বিষয়, ব্যবস্থাপনা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা কম। টাকা খরচ করার সক্ষমতা তাঁদের নেই। গতকাল ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও নাগরিক সংগঠন হেলথ ওয়াচ আয়োজিত স্বাস্থ্য বাজেট ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ইকবাল আনোয়ার এ কথা বলেন।
একই অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মুনির হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজের অনেক ফাঁক আছে। নজরদারি করার মতো দৃঢ় কাঠামোও নেই। তিনি বলেন, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার কাজের (সিডিসি) পরিধি স্পষ্ট নয়। এদের কাজে সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে করোনাবিষয়ক অনেক কাজের গতি শ্লথ হয়ে গেছে।
এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিডিসি ও আইইডিসিআর সম্পূর্ণ পৃথকভাবে কাজ করে। প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট কাজ রয়েছে।
করণীয়
জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, স্কুল-কলেজ, বড় বড় বিপণিবিতান ও সিনেমা হল বন্ধ রাখা, গণজমায়েত হতে না দেওয়া, গণপরিবহন বন্ধ ও যাত্রী সীমিত করায় কিছু প্রভাব আছে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে। এখন তিনটি কাজ গুরুত্বের সঙ্গে করা উচিত। প্রথমত ১০০ শতাংশ মানুষকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে, দ্বিতীয়ত সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যাপারে মানুষকে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে এবং তৃতীয়ত বাড়িতে, রাস্তায়, জনপরিসরে বা কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বড় বড় শহরের ছোট ছোট এলাকায় লকডাউন (অবরুদ্ধ) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে কিছুদিন ধরে আলোচনা চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউন চলছে, ওয়ারীতেও শুরু হবে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীতে সীমিত আকারে শুরু হয়েছে। পরে আরও অনেক এলাকায় এটা হবে।
সূত্র বলছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার জন্য বড় এলাকা লকডাউনের আওতায় আনতে চায় না সরকার। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আক্রান্ত ব্যক্তির অঞ্চলভিত্তিক তথ্য না থাকায় ছোট ছোট এলাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর করতে হবে। তথ্যের জন্য অপেক্ষা না করে ঝুঁকিপূর্ণ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় লকডাউন বাস্তবায়ন শুরু করা দরকার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের উদাহরণ টেনে বলেন, বড় বড় শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় হঠাৎ ঘনীভূত মহামারি বিস্ফোরণের আশঙ্কা আছে। এমন ঘটলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।