ঢাকা শহরের সড়ক আর অলিগলি এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা নেই। চলছে না যানবাহন। মরণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সব মানুষ এখন ঘরে অবস্থান করছে।
চিরচেনা ব্যস্ত নগরীর বদলে ঢাকা এখন অন্য রকমের এক শহর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কোনো যানবাহন তেমন চোখে পড়ে না।
পুরান ঢাকার নবাবপুরের বাসিন্দা শরীফ হোসেন। পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন নয়াবাজারে। ওষুধ কেনার জন্য রাস্তায় বের হন। ব্যবসায়ী শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তায় পুলিশ, সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। রাস্তায় মানুষ নেই। নেই কোনো গাড়ি। অসুস্থ হলে কেমনে কী করব, বুঝতে পারছি না। সর্দি-জ্বর হলে তো বিপদ?’
এই প্রশ্ন, এই জিজ্ঞাসা কেবল একা শরীফের নয়, ঘরে থাকা অনেকে চিন্তিত, সর্দি, কাশি, জ্বর হলে কী করবেন? কোথায় চিকিৎসা নেবেন?
সর্দি, কাশি, জ্বরসহ যে কোন রোগের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য দেশের দুটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হটলাইন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আগামী শনিবার থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০টি হটলাইন নম্বর চালু হবে। আর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচটি নম্বর চালু থাকবে।
দেশের সর্ববৃহৎ সরকারি হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের জরুরি এই সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০টি হটলাইন নম্বর চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেনা হয়েছে মুঠোফোন। মুঠোফোনে এই সেবা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকবে। যেকোনো ব্যক্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজের এই হটলাইন নম্বরে ফোন দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা নিতে পারবেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) করোনা আইসোলেশন ইউনিটের কো-অর্ডিনেটর অসীম চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী শনিবার থেকে আমাদের হাসপাতালে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। লকডাউনের এই সময়ে দুটি হটলাইন নম্বর চালু রয়েছে। শনিবার থেকে মোট পাঁচটি হটলাইন নম্বর চালু হবে। যেকোনো ব্যক্তি ২৪ ঘণ্টা এই হটলাইন নম্বরের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে পারবেন।’
সবাই চিকিৎসা পাবেন
সর্দি, কাশি আর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যাঁরাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসছেন, তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এসব রোগীর চিকিৎসায় স্থাপন করা হয়েছে আলাদা ইউনিট।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউনের কারণে এই মুহূর্তে হাসপাতালে হাঁচি, কাশি, সর্দি, জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম আছে। যদি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়, আমরা যদি প্রয়োজন মনে করি, তাহলে আলাদা বহির্বিভাগ আবার চালু করে দেব। ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়ার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। কোনো রোগী ঢাকা মেডিকেল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।’
>দুই হাসপাতালেই শনিবার চালু হচ্ছে হটলাইন
আইসোলেশন ইউনিট চালু হয়েছে
সলিমুল্লাহ মেডিকেলে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা হবে
কাউকে ফেরত যেতে হবে না, বলছে কর্তৃপক্ষ
আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, ‘সর্দি, কাশি, জ্বর নিয়ে যাঁরা আসছেন, তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমরা কোনো রোগী ফেরাই না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কখনো না বলে না। জাতির এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সব রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যদি কখনো কাউকে সাসপেক্ট (সন্দেহ) করি যে তিনি করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন, তখন সেই রোগীকে করোনা আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তখন আমাদের চিকিৎসকেরা তাঁকে পরীক্ষা করবেন। তাঁকে জরুরি সেবা দেওয়ার প্রয়োজন হলে, তা দেওয়া হয়। পরে আমরা সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) জানাই। তখন আইইডিসিআরের লোকজন আমাদের এখানে আসেন। তাঁরা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেন। যদি করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়, তখন সরকার–নির্দেশিত হাসপাতালে ওই রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’
চিকিৎসক আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এমন ব্যক্তি পরে করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়েছে।’ তবে কতজনের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়েছে, তা জানাতে পারেননি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটের কো-অর্ডিনেটর অসীম চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে থাকা ব্যক্তিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এসব রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আলাদা একটি কক্ষের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে করোনা আইসোলেশন ইউনিট। এখন পর্যন্ত সেখানে পাঁচটি বেড রয়েছে।’
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছেন ৪৪ জন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন পাঁচজন। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৭৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসে আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২২ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ৪ লাখ ৮৫ হাজারেরও বেশি।
আইইডিসিআর বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে সময় লাগে ১৪ দিন। এই সময়ে সবাইকে স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। বাড়িতে একা একা থাকতে হবে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ দেখা দিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইনে যোগাযোগ করতে পারবেন। নতুন হটলাইন নম্বর ১৬২৬৩।
চিকিৎসকেরা বলছেন, সাধারণত জ্বর দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। পরে দেখা দিতে পারে শুকনো কাশি। এর সঙ্গে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়া, গলাব্যথা, জ্বর ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এসব লক্ষণ প্রকাশের পর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।