করোনাকালে 'বনফুলের জন্য জুম্ম তারুণ্যের ভালোবাসা'

বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ ‘বনফুলের জন্য জুম্ম তারুণ্যের ভালোবাসা’।
বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ ‘বনফুলের জন্য জুম্ম তারুণ্যের ভালোবাসা’।

পাহাড়ের গায়ে জেগে ওঠা নতুন সবুজ জানিয়ে দিচ্ছে, আবার এসেছে আষাঢ়। এরই মধ্যে জুমের (পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত চাষপদ্ধতি) জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এ জন্য পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল নির্বাচিত জুম খেতের ঝোপঝাড়, ছোট গাছপালা। এখন নববর্ষার পানি পেয়ে উন্মুখ সবুজ ফসল। মেটে পাহাড়ে সবুজের ছোপ।

এ সময়টায় জুমিয়াদের (জুমচাষি) মনও থাকার তো কোনো কারণ নেই। কিন্তু পাসিং ম্রো বা রুংনাজন ত্রিপুরার মতো জুমিয়াদের মন ভালো নেই। ভালো নেই পাহাড়; যে কারণে ভালো নেই বাংলাদেশ, পুরো বিশ্ব। করোনার ভয়াল থাবা বসেছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীতে।

কিন্তু দূর পাহাড়ের মানুষের দুর্গতির কথা কজনেরই–বা কানে পৌঁছায়? তবে এসব মানুষের কথা ভাবার মানুষও আছে। তাঁরা বয়সে নবীন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়া পাহাড়ি শিক্ষার্থী। তাঁদের উদ্যোগ ‘বনফুলের জন্য জুম্ম তারুণ্যের ভালোবাসা’।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একটি পেজ খুলে তাঁরা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য সহায়তার ডাক দিয়েছিলেন। যে যেভাবে পারেন, সহভাগী হোন তাঁদের উদ্যোগে। সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন অনেকে, পাহাড়ি-বাঙালি। এসব তরুণ খুঁজে খুঁজে বের করেছেন কোন মানুষগুলো সবচেয়ে কষ্টে আছে। সে যত দূরের মানুষই হোক, তার কাছে পৌঁছে গেছে এসব তরুণের ভালোবাসার উপহার।

বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ ‘বনফুলের জন্য জুম্ম তারুণ্যের ভালোবাসা’।

এ উদ্যোগের শুরুটা কোভিড সংক্রমণের শুরুর দিক থেকেই। উদ্যোক্তাদের একজন সতেজ চাকমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী। দেখলেন, কোভিডের সংক্রমণ বাড়ছে। বাড়ছে দুর্গতি। এর আগে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির সাজেকে হামে আট শিশুর মৃত্যুর পর সহযোগিতা করেন এসব শিক্ষার্থী। এবার কোভিডের হানায় তাঁরা আরও কোমর কষে নামলেন।

সতেজ বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা কিছু করতে চাইছিলাম পাহাড়ের কষ্টে থাকা মানুষের জন্য। কিন্তু আমাদের সামর্থ্য বেশি নেই। সহায়তা নিলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের। ফেসবুকে খোলা হলো পেজ। সেখানে জানানো হলো সহায়তার আবেদন। দেশ-বিদেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী এতে সাড়া দিলেন।’

মানবতাবাদী মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রতি সপ্তাহের শনিবার গুণী শিল্পীদের নিয়ে ‘বনফুলের জন্য গান’ নামে মিউজিক্যাল সেশনের আয়োজন করেছেন এসব তরুণ। এর মাধ্যমে দেশ-বিদেশের অনেক মানবতাবাদী মানুষ তাঁদের আহ্বানটুকু জানতে পেরেছেন। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বনফুলদের জন্য তহবিলে ভালোবাসা পাঠিয়েছেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে। অনেকেই ছবি এঁকে কিংবা নিজেদের ক্যামেরায় তোলা ছবি বিক্রি করে তহবিলে সহায়তা করেছেন।

উদ্যোক্তাদের একজন চন্দ্রা ত্রিপুরা বলছিলেন, ‘শুধু সহায়তার জন্য আবেদনই না। এ পেজ একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে গেল। কোনো গায়ক তাঁর গান শেয়ার করলেন, কেউ কবিতা।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের খ্যাতনামা গায়ক রঞ্জিত দেওয়ান ভিডিওবার্তায় সংহতি জানালেন। চাকমা সার্কেল প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় জানালেন আশিসবাণী। এসব বরেণ্য মানুষের সংহতি এসব তরুণকে উদ্দীপ্ত করল। জুম্ম তারুণ্যের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জমা পড়ল ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এখন এ অর্থে সহায়তা করা হবে কাদের? সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল জটিল কাজ। কিন্তু এসব তরুণ ঠিক খুঁজে বের করলেন সঠিক মানুষদের।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের কেওক্রাডাং পাহাড়ের কাছের গ্রাম পাসিংপাড়া। সেই দুর্গম গ্রামের মানুষ ছিলেন কষ্টে। তরুণদের সহায়তা পৌঁছাল সেখানে। ভরা বর্ষায় রাইংখ্যং নদী যখন ভরা থাকে পানিতে, তখনো ফারুয়ার মতো দুর্গম স্থানে পৌঁছাতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগে যন্ত্রচালিত নৌকায়। রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের আলিখ্যং গিপুরাপাড়ার অসহায়ত্বের কথা পৌঁছেছিল তরুণদের কানে। তাঁদের ভালোবাসা পৌঁছেছে সেখানে। জেরি বলছিলেন, ‘খাদ্যাভাবে অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। পরিবারে শিশু আছে বয়স্ক আছে। যে সাহায্য এখন পেয়েছি, অন্তত কিছুদিন চিন্তামুক্ত থাকব।’

কীভাবে সম্ভব হলো এসব দূরের মানুষদের হদিস বের করা? চন্দ্রা বললেন, ‘আমরা স্থানীয় হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) ও কারবারিদের (পাড়াপ্রধান) সহায়তা নিয়েছি। তাঁরা তথ্য দিয়েছেন। এর পাশাপাশি এসব এলাকার শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে খবর নিয়েছেন। সব তথ্য আমরা আবার ক্রসচেক করেছি। তারপর পৌঁছে দিয়েছি সহায়তা।’

বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ ‘বনফুলের জন্য জুম্ম তারুণ্যের ভালোবাসা’।

এ পর্যন্ত ৫২৫ পরিবার পেয়েছে সহায়তা। পরিবারপ্রতি ১ হাজার বা ১ হাজার ২০০ টাকা করে ধরা হয়েছিল। এ অর্থে কারও জন্য চাল-ডাল, কারও জন্য তরকারি, যার যেটা দরকার দেওয়া হয়েছে।

এ উদ্যোগে শামিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রেং ইয়ং ম্রো বলছিলেন, ‘আমরা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এর বেশি সামর্থ্য ছিল না আমাদের। আমরা দেখেছি, কোন মানুষটা বেশি কষ্টে আছে, তাঁকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি।’

পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি জাতিসত্তার মানুষের বাস। তরুণদের এই সহায়তার ক্ষেত্রে মেনে চলা হয়েছে জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক ভারসাম্য। সব সম্প্রদায়ের মানুষ যেন এই সহায়তা পান, সেদিকে তাঁরা নজর রেখেছেন।

এই পেজে তরুণদের নম্বর আছে। সেখানে সরাসরি যোগাযোগ করে অনেকে তাঁদের সহায়তা দিয়েছেন। আবার অনেক সংগঠন সরাসরি নিজেরা সহায়তা করেছে। তাদের কাছে থেকে দুস্থ মানুষের তালিকা নিয়েছে। তরুণেরা কার্পণ্য করেননি এসব দিতে।

সতেজ চাকমা জানান, তাঁদের তোলা সমস্ত অর্থ দেওয়া হয়ে গেছে। এখন কেউ চাইলে তাঁদের পেজে থাকা নম্বরে যোগাযোগ করে সহায়তা দিতে পারেন। এগুলো পৌঁছে যাবে মানুষের কাছে।

তরুণদের এ উদ্যোগে ওলোনশাল স্টুডিও এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান পাহাড়ি শিক্ষার্থীরাও তহবিলে সহায়তা করেছেন। সহায়তা পাঠিয়েছেন অল ইন্ডিয়া চাকমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল। এ ছাড়া ‘ঝিমিত ঝিমিত জুনিজ্বলে’ নামে একটা ভার্চ্যুয়াল গ্রুপে গানের প্রতিযোগিতার মাধ্যমেও এ তহবিলে সহায়তা এসেছে। তবে তরুণেরা এসব সহায়তাকে ‘ত্রাণ’ বলেন না; বলেন ‘ভালোবাসার উপহার’।

তরুণদের এই উদ্যোগের নাম কেন হলো ‘বনফুলের জন্য জুম্ম তারুণ্যের ভালোবাসা’?

উদ্যোক্তাদের একজন পল্লব চাকমা বললেন, ‘আমরা পাহাড়ের প্রতিটি মানুষকে এক একটা বনফুল মনে করি। পাহাড়ে বিবর্ণ ফুল আমরা দেখতে চাই না। চাই স্নিগ্ধ, সৌরভ ছড়ানো পাহাড়ি বনফুল। আর সেই বনফুল রক্ষার জন্য আমাদের এই উদ্যোগ।’