স্বামী ব্যবসায়ী, স্ত্রী চাকরিজীবী। মধ্যবয়সী এই দম্পতি গত আগস্টে করোনায় আক্রান্ত হন। রাজধানীর বিশেষায়িত একটি হাসপাতালে দুজনই ১৪ দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এরপর শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলেও দুজনই মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের আচরণে অস্বাভাবিকতা এসেছে—দুজনই তা লক্ষ করেছেন।
গত সপ্তাহে তাঁরা চিকিৎসা নিতে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে যান। তাঁরা বলছেন, কাউকে সহ্য করতে পারছেন না এখন। কেমন আছেন—কেউ এ কথা জানতে চাইলেও খেপে যাচ্ছেন। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে, মাথা ঘোরায়, ঘুম হয় না, কিছু মনে রাখতে পারছেন না, চোখে কম দেখছেন, ক্ষুধা বাড়লেও অত্যন্ত দুর্বল লাগে। কিছুক্ষণ কাজ করলেই ক্লান্তি বোধ হয়। সব সময় অনিশ্চয়তায় ভোগেন, ভয় পাচ্ছেন সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
করোনাকালে এমন মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগ নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন, এমন ১৫ জন চিকিৎসক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, করোনাকালে সাত ধরনের মানসিক রোগী তাঁদের কাছে বেশি আসছেন। করোনায় সংক্রমিত হবেন—এ নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ; করোনা সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পর মানসিক অবসাদ; আবারও করোনা হতে পারেন, এ নিয়ে ভয়; করোনা সংক্রমিত হয়ে যাঁরা ভর্তি আছেন, তাঁদের অতিরিক্ত ভয়; শিশু–কিশোরদের দীর্ঘদিন সামাজিক দূরত্বে থাকার ফলে বিষণ্নতা এবং চাকরি হারানো ও বেতন কমে যাওয়ার চাপ।
বেশির ভাগ চিকিৎসকই প্রথম আলোকে বলেছেন, অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তাঁদের মানসিক সমস্যা হয়েছে। ফলে এই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। তাঁদের মতে, করোনামুক্ত হওয়ার পর বেশির ভাগ মানুষই নানা জটিলতা নিয়ে আবার হাসপাতালে আসছেন।
‘সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য: অধিক বিনিয়োগ অবাধ সুযোগ’ স্লোগান নিয়ে আজ ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অবশ্য এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানসিক চাপ দূর করতে আমরা কাজ করছি। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় পৃথক উপকমিটি গঠন করেছি, হেল্পলাইন চালু করেছি, টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছি। ঘরে আটকানো অবস্থায় থাকলে চাপ বাড়ে, বিষণ্নতা দেখা দেয়। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে উৎসাহী করছি।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে দিনে গড়ে ৬০০ রোগী আসত। এখন আড়াই শ’র মতো রোগী আসে। তবে এই রোগীদের বেশির ভাগই শহুরে এবং করোনাসংক্রান্ত নানা সমস্যা নিয়ে আসছেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো চাপে মানসিক সমস্যা বাড়ে। আর করোনা তো মানুষকে সবদিক থেকে চাপে ফেলে দিয়েছে। তবে দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের মানুষ তো অতটা সচেতন নয়, তাই এসব রোগী অন্য চিকিৎসকের কাছে যান। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত থেকে যায়।’
রোগীদের কী পরামর্শ দেওয়া হয়, জানতে চাইলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও একই প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, ‘আমাদের কাছে এলে আমরা থেরাপি ও মেডিকেশন দিই। এ ছাড়া কাউন্সেলিং করি।’
কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত তরুণ বা যুবকদেরও অনেকের শরীরে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনাকালে ৯১ শতাংশ শিশু–তরুণ মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এ সময় শিশু, কিশোর, তরুণদের ঘুমের সমস্যা ও উদ্বেগ অনেক বেড়ে গেছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু–কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনাকালে তরুণ রোগী বেড়েছে। বিশেষ করে যারা পরীক্ষার্থী ছিল। কী পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের, জানতে চাইলে হেলাল উদ্দিন বলেন, রুটিনের বড় ধরনের পরিবর্তন করা চলবে না। মা–বাবাকে সন্তানদের বোঝাতে হবে যে করোনাভাইরাসের বাইরেও জীবন আছে।
মানসিক চাপে আছেন বয়স্ক ব্যক্তিরাও। বেশির ভাগই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। সংক্রমণের শুরুর দিকে বলা হয়েছিল, বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশি আক্রান্ত হবেন, তখন থেকেই তাঁদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। এরপর যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ বেশি দেখা যাচ্ছে। আর যাঁদের হয়নি, তাঁরাও সংক্রমণের ভয়ে থাকেন।