করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশে অনেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। কেউ আতঙ্কিত-ভীত হচ্ছেন। আর এ কারণে অনেকে অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় পড়েছেন। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে জীবন যাপন করলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থ হয়ে যান।
করোনা মহামারির শুরু থেকেই বহু মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন। বেসরকারি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ‘মনের বন্ধু’ ইউএনডিপির সহায়তায় ছয় মাস ধরে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত কয়েক হাজার রোগীকে সেবা দিয়ে আসছে। করোনার সংক্রমণের মাত্রা ওঠানামা করলেও রোগীর সংখ্যা কমেনি। এ ধরনের তথ্য জানান মনের বন্ধুর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তৌহিদা শিরোপা।
তৌহিদা শিরোপা প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মহামারি শুরুর পর ২৭ মার্চ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার ফোনকল পেয়েছি। দেশের ২৬টি জেলা থেকে এসব ফোন এসেছে। দেশের বাইরে থেকেও অনেকে ফোন করেছেন। যাঁরা বা যাঁদের স্বজনেরা কল করেছেন, তাঁদের মধ্যে করোনার কারণে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন ৯৮ শতাংশ। বাকি ২ শতাংশ মানসিক অন্য সমস্যায় ভুগছিলেন।
মনের বন্ধুর সিইও তৌহিদা শিরোপা বলেন, প্রথম দিকে কল করতেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশ করতেন করোনায় আতঙ্কিত ও ভীত হয়ে। পরবর্তী সময়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লে, সুস্থ হয়ে ওঠা লোকজন ফোন করতেন। দেখা যায়, কিছুটা শ্বাসকষ্ট বা শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিলে ভয়ে অনেকে ফোন করেন। ৯ থেকে ২০ বছর বয়সী অনেকে পরামর্শ বা কাউন্সেলিং করিয়েছেন আমাদের এখানে। অসংখ্য অভিভাবকও তাঁদের সন্তানদের মানসিক সমস্যার কারণে কাউন্সেলিং করেছেন। তাতে করে বোঝা যায়, শিশুদের করোনাভীতি ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। এখনো প্রচুর কল আসছে। ফোর–জি ইন্টারনেটের এই যুগে, প্রতিদিন করোনায় মানসিক অসুস্থ প্রায় ৫০ জনকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে হোয়াটস অ্যাপে আমাদের বিশেষজ্ঞরা কাউন্সেলিং করাচ্ছেন।
তবে পেশাজীবীদের মধ্যে বড় অংশ করোনা–আতঙ্কে মানসিক সমস্যায় পড়েছেন। করোনাভীতি ছাড়াও তাঁদের মধ্যে কেউ চাকরি হারিয়ে, কেউ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছেন মনের বন্ধুর। এমনই একজন হলেন কামাল মাহমুদ (ছদ্মনাম)। পেশায় গণমাধ্যমকর্মী। করোনা–পূর্ববর্তী জীবনে দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫-১৬ ঘণ্টা পেশাগত ও পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু করোনা মহামারি অনেকের মতো তাঁর জীবনাচরণকে একেবারে বদলে দিয়েছে। হোম অফিসের কারণে নিজেকে তিনি অনেকটা ঘরবন্দী করে ফেলেন। একাকী থাকায় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে দূরে সরে যান। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যান কামাল মাহমুদ। টানা চার মাস রাতে ঘুমাতে পারেননি। মুখে অরুচি। তাই ঠিকমতো খেতে না পারায় তাঁর ওজন কমে যায় ২২ পাউন্ড। শেষ পর্যন্ত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ নিতে শুরু করেন তিনি। মনের বন্ধুর এক বিশেষজ্ঞের কাউন্সেলিংয়ে তিনি অংশ নিচ্ছেন। বেশ কয়েকটি সেশনে অংশ নিয়েছেন। মন খুলে কথা বলেছেন। শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কথা সবই জানিয়েছেন। দীর্ঘ ছয় মাস পর বেশ সুস্থ বোধ করছেন তিনি।
কামাল মাহমুদ বলেন, কাউন্সেলিংয়ের সময় কথা বলে নিজেকে বেশ হালকা মনে হয়। একটা ফুরফুরে ভাব অনুভূত হয়। একাকী থাকলে অবশ্য কিছু দুশ্চিন্তা লাগে। তবে পরিচিতজনের মধ্যে এলে জড়তা, আতঙ্ক বা ভীতি বেশ কমে যায়। অনেকটা সময় কেটেও যায়।