দেশের আরও দুই প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিন নকশা উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্সিং) করেছে। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়। আজ বৃহস্পতিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জিন নকশা উন্মোচনের এ তথ্য জানানো হয়। কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের নির্দেশেই এ নকশা উন্মোচনের কাজ হয় বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
১২ মে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচন করে। এ কাজে নেতৃত্ব দেন প্রতিষ্ঠানটির অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা।
জিনোম হলো জীবের জিনগত বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। বংশগতির সব বৈশিষ্ট্যই এক বা একাধিক জিনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব বৈশিষ্ট্যের তথ্য জানার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো জিন নকশা উন্মোচন। এ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কৌশল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে বাস্তবায়নাধীন পাটবিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্পের (জুট জিনোম প্রকল্প) অধীন এবারে করোনার জিন নকশা উন্মোচিত হলো।
পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষে এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পাট নিয়ে কাজ করি। সব জেনোম একই রকমের। তাই ভাইরাসেরও করতে পারি। কিন্তু আমাদের কাছে নমুনা ছিল না। আমরা চট্টগ্রাম থেকে প্রাপ্ত নমুনা প্রক্রিয়াজাত করে সিকোয়েন্স করে গতকাল বুধবাত রাত ১১টার দিকে জমা দিয়েছি।’
মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে সংক্রমিত নভেল করোনার সাতটি নমুনা ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করেছি। উন্মোচিত জিনোম তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিকোয়েন্সগুলোর সঙ্গে সৌদি আরব, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকোয়েন্সের মিল রয়েছে।’
এ গবেষণায় চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নেতৃত্ব দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিকোয়েন্সের কাজে আমাদের নমুনা দিয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিশেষায়িত হাসপাতাল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (বিআইটিআইডি)। এখানে চট্টগ্রাম বিভাগের সাতজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সাতটি ভাইরাসের নমুনা নিয়ে নকশা উন্মোচন করা হয়। এরপর আমরা তা প্রক্রিয়াজাত করে নমুনাগুলো পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে পাঠাই। এরপর তারা কাজ করেন।’
অধ্যাপক গৌতম বুদ্ধ দাশ বলেন, সিঙ্গাপুরের কিছু জিনোমের ক্ষেত্রে লক্ষ করা গেছে।
ফ্লু ভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচন করলেই তা উন্মোচনকারীরা জিআইএসএআইডি ডেটাবেইসে আপলোড করে দেয়। এই দুই প্রতিষ্ঠানও তাদের নকশা উন্মোচনের তথ্য এই ডেটাবেইসে জমা দিয়েছে। সেখানে দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটেও এটা আপলোড করা হয়েছে।
তাদের নমুনা সরবরাহ করে। ভাইরাসটি এর রূপ দ্রুত পরিবর্তন করছে। সাতজনের করোনাভাইরাসের নমুনা নিয়ে এক নকশা উন্মোচন করা হয়।
গৌতম বুদ্ধ দাশ বলেন, সাতটির মধ্যে দুটি নমুনার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের কিছু জিনোমের মিল লক্ষ করা গেছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশে যার দেহে পাওয়া গেছে, তিনি সিঙ্গপুর থেকে এসেছিলেন বা সিঙ্গাপুরের ভাইরাসের সংস্পর্শে ছিলেন। উন্মোচিত জিন নকশার সঙ্গে একটি জিনোমের সাতটি স্থানে, দুটিতে পাঁচটি স্থানে এবং চারটিতে চার স্থানে মিউটেশন বা পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে বলে জানানো হয়।
শহীদুল ইসলাম বলেন, ভাইরাসটি আরও আক্রমণাত্মক হলো না নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল, তা বুঝতেই এই পরিবর্তন বা মিউটেশন জানা জরুনি।
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নতুন (নভেল) করোনাভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হতে থাকে। একপর্যায়ে সারা বিশ্বে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসের সংক্রমণক্ষমতা অনেক বেশি। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির গতিপ্রকৃতি জানার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার ল্যাবরেটরিতে এর জিন বিশ্লেষণ হয়েছে। ওষুধ ও টিকা বিজ্ঞানীরাও এই বিশ্লেষণের তথ্য তাঁদের গবেষণায় ব্যবহার করছেন।
আর ওষুধ ও টিকার ক্ষেত্রে এই জিন নকশা উন্মোচন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরাসবিদ নজরুল ইসলাম। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন টিকা নেব, তখন করোনাভাইরাসের এই জিন নকশার সঙ্গে মিল দেখা হবে। তখন টিকা কাজে আসবে।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আরও বেশি বেশি নমুনার জিন নকশা উন্মোচন দরকার। এটা হলে এর মিউটেশন বা রূপ পরিবর্তনের চিত্র প্রকাশ পাবে। এর গতিপ্রকৃতি আমরা চিনতে পারব।’