দুই ঠিকাদারের প্রাধান্য

কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বেশি মনোযোগ

কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের একটা বড় উদাহরণ এই ডেমু ট্রেন l প্রথম আলো
কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের একটা বড় উদাহরণ এই ডেমু ট্রেন l প্রথম আলো

দরকারি প্রকল্পে অর্থায়ন না করে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা ঘটছে রেলওয়েতে। আবার কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে তোড়জোড় দেখা গেছে। এভাবে অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে বিনিয়োগের পুরো সুফল পাচ্ছে না রেল।
এর বড় উদাহরণ চীন থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকায় ডেমু ট্রেন ক্রয়। ইঞ্জিন-বগির প্রকট সংকটের সময় নিজস্ব অর্থায়নে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনা হয়। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন দায়িত্ব নিয়েই এই প্রকল্প গ্রহণ করেন। এই ট্রেন নামানোর পরই দেখা যায়, এতে পর্যাপ্ত বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। আসনের অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে এটি চালুর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ঢাকার যানজট নিরসনের কথা বলে।
এখন দুই সেট ডেমু জোড়া দিয়ে একটি করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে চলছে। দিনে আসা-যাওয়া মিলে চলে ছয়বার। বেশির ভাগ ডেমু ট্রেন চলছে ঢাকার বাইরে, দূরের পথে। এ অবস্থায় আবারও ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনার প্রাথমিক দরপত্র আহ্বান করেছে রেলওয়ে। এগুলো গাজীপুরের হাইটেক পার্কের আশপাশে চালানো হবে বলে সূত্র জানায়।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় সবচেয়ে বেশি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঠিকাদারের স্বার্থ ও কমিশন-বাণিজ্য। রেললাইন নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের ৮০ শতাংশ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ। তমার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভূঁইয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আর এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে একজন প্রতিমন্ত্রী জড়িয়ে আছেন বলে সূত্র জানায়। আর ম্যাক্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের বাড়িও নোয়াখালী জেলায়। তিনি অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই রেলে কাজ করছেন। এই দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে রেলের সাবেক অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাকরি করেন।
বর্তমানে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে গোপালগঞ্জ ও পাবনায়। ২০১০ সালের দিকে রাজস্ব খাত থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায় কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া পথের লাইন সংস্কার ও কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ ও টুঙ্গিপাড়া পথে নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ৬০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। প্রায় একই সময়ে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকায় ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এটিও রাজস্ব খাতের প্রকল্প। বাস্তবায়নও করা হয়েছে দ্রুত। ইতিমধ্যে ৭৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
রেলের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, এসব প্রকল্প নেওয়ার আগে যাত্রী চাহিদা কিংবা লাভ-লোকসানের বিষয়টি কমই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এগুলোর চেয়েও জরুরি ছিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে নতুন রেললাইন নির্মাণ ও ইঞ্জিন-বগি কেনা। কারণ, এই পথে যাত্রী চলাচল সবচেয়ে বেশি।
রেলের অভ্যন্তরীণ হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে এখন দিনে ৩২ বার ট্রেন আসা-যাওয়া করে। যাত্রী যাতায়াত করে দৈনিক গড়ে ২৫ হাজার। এই পথে আরেকটি রেললাইন নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিলেন রেলের অনেক কর্মকর্তা। কিন্তু সময়ক্ষেপণ করে শেষমেশ ২০১৪ সালে আরেকটি মিশ্রগেজ লাইন নির্মাণে ৩৭৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় পর এখন ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দূরত্ব কমে যায় প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। অথচ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে রেলের আগ্রহ কম।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যেসব প্রকল্প প্রয়োজন মনে করেছি, সেগুলো আগে নিয়েছি। এখানে রাজনৈতিক কোনো কারণ নেই। আগের সরকারগুলো কাজই করেনি। আমরা তো করছি।’ ডেমু আমদানির বিষয়ে তিনি বলেন, শুরুতে এর কিছু কারিগরি সমস্যা ছিল। এখন আর সমস্যা নেই।
আগ-পিছ না ভেবে প্রকল্প
ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ১২৫ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণ শেষ হয়েছে গত বছর। এখন এই রেলপথটি ব্রডগেজ ট্রেনের চলার উপযোগী করার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে আখাউড়া থেকে লাকসাম অংশে মিশ্রগেজ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বাকি পথও মিশ্রগেজ করার প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে।

>তমা ও ম্যাক্স বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে মিলে কাজ করছে। তাদের সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই
মুজিবুল হক, রেলমন্ত্রী

রেলওয়ে সূত্র বলছে, আসলে এই পথে এখন মিশ্রগেজ লাইন করা অনেকটাই বিলাসিতা। কারণ, রেলের পূর্বাঞ্চলের কোথাও ব্রডগেজের অবকাঠামো নেই। আর যদি ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করতেই হয়, তাহলে ১২৫ কিলোমিটার নতুন মিটারগেজ লাইনের প্রকল্প নেওয়ার সময়ই তা মিশ্রগেজের জন্য নেওয়া উচিত ছিল। এতে খরচ কম হতো।
২০১৩ সালের দিকে রেল কর্তৃপক্ষ ভারত থেকে ২২০টি কনটেইনার আমদানি করে। আরও কিছু যন্ত্রপাতিসহ কনটেইনার ক্রয় প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। মালামাল পরিবহন কমে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ কনটেইনার এখন অলস পড়ে থাকছে।
ইঞ্জিন-বগি কেনায় ঢিলেমি
রেলে ইঞ্জিনের সংকট প্রকট। ২০১০ সালে ভারতীয় ঋণে ২৬৪টি মিটারগেজ বগি কেনার জন্য প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। ২০১২ সালে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ছয় বছরে একটি বগিও কিনতে পারেনি রেলওয়ে। নিজেদের অর্থ বা অন্য কোনো সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি প্রকল্পটি।
একই অবস্থা ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার ক্ষেত্রেও। ২০১১ সালে নেওয়া এই প্রকল্পের একচুলও অগ্রগতি নেই। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নেওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে খুলনা স্টেশন আধুনিকায়নে ৭৯ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
দুই ঠিকাদারই সব
রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ। রেললাইনে ব্যবহারের জন্য সুনামগঞ্জের ছাতকে রেলের একটি নিজস্ব কংক্রিট স্লিপার তৈরির কারখানা রয়েছে। কিন্তু এটি এখন প্রায় অকেজো করে রাখা হয়েছে। এই সুযোগে ম্যাক্স ও তমা গ্রুপ নিজেরা স্লিপার তৈরির কারখানা স্থাপন করে ফেলেছে। এখন রেলের প্রকল্পে এই দুই প্রতিষ্ঠানের স্লিপার ব্যবহার করা হয়। তমার স্লিপার কারখানা জামালপুরে আর ম্যাক্সেরটি পঞ্চগড়ে। বর্তমানে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার স্লিপার দরকার হয় রেল কর্তৃপক্ষের। রেলের স্লিপার কারখানা নির্মাণ করা হয় ১৯৮৮ সালে। কারখানার সহযোগী হিসেবে ভোলাগঞ্জে রয়েছে পাথর সংগ্রহের কারখানা। সংগ্রহ করা পাথর স্লিপার কারখানায় আনার জন্য রয়েছে রূপওয়ে (তারের পথ)। এখন এর সম্পদ বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
রেলের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটির স্বার্থেই কর্তৃপক্ষ এই কারখানাটি অকেজো করে রেখেছে।
তমা ও ম্যাক্স অবাধে রেলের সম্পদ ব্যবহার করছে। সেনানিবাস রেলস্টেশনের পাশে রেলের জায়গায় দীর্ঘদিন অফিস নির্মাণ করে তা ব্যবহার করে ম্যাক্স। ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পের পথে হওয়ার কারণে সম্প্রতি এই অফিস সরিয়ে নেওয়া হয়। তমাকে গোপীবাগে রেলের জায়গায় নির্মাণ যন্ত্রপাতি রাখার অনুমতি দিয়েছে রেলওয়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তমা গ্রুপের মূল কাজ ছিল সড়ক খাতে। এখন প্রতিষ্ঠানটি রেলের কাজ বেশি করছে। জোট সরকারের আমলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বরকতউল্লার সঙ্গে তমার চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের সঙ্গে। মির্জা আজম প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তা স্বীকার করেন।
জানতে চাইলে তমার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মির্জা আজম আমার ২৫-৩০ বছরের পুরোনো বন্ধু। ব্যবসায়িক সম্পর্কের কোনো বিষয় নেই। আর রেলের কাজ করার জন্য যে যন্ত্রপাতি কিনেছি, তা রেলেও নেই। এই বিনিয়োগ করার কারণেই তো টাকা দেশে থাকছে। নতুবা বিদেশে চলে যেত।’ বিএনপির বরকতউল্লার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসা করলে সবার সঙ্গেই সম্পর্ক থাকতে হয়। বরকতউল্লা আমার নিজ এলাকার সাংসদ ছিলেন।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে থারেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে মিলে কাজ করছে। তাদের প্রতি বিশেষ কোনো নজর নেই। বাড়তি সুবিধা (ফেভার) দেওয়ার সুযোগ নেই। দরপত্রের শর্ত পূরণ যারা করবে তারাই কাজ পাবে। এখানে রাজনৈতিক পরিচয় কোনো বিবেচনায় কে না। (শেষ)