কমানোর অঙ্গীকার থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে

.

জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে গড়ে ২৪ জন মারা গেছেন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের চিত্রও ছিল একই। অবশ্য পুলিশের হিসাবে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান গড়ে ৬ জন।
সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে জাতিসংঘের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ সই করেছে। বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের।
এসব মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কোন বছর কত সড়ক দুর্ঘটনা কমানো হবে, এর কোনো কর্মপরিকল্পনা এখনো হয়নি। কিছু সড়কের বাঁক সোজা করা এবং মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ছাড়া সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। গত বছর সরকার ১৪৪টি সড়কের বাঁক সোজা করার প্রকল্প নিয়েছে।
গতকাল শনিবার বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে ২০১৫ সালের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, গত বছর সারা দেশে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮ হাজার ৬৪২ জন। আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন।
সংগঠনটির হিসাবে, ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৫ হাজার ৯২৮টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৮ হাজার ৫৮৯ জন। আর আহত হয়েছিলেন ১৭ হাজার ৫২৪ জন। এসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত খবর থেকেই নিয়েছে সংগঠনটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গত বছরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়।
আর সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনার হিসাব রাখে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ গত বছরের হিসাব এখনো চূড়ান্ত করেনি। তবে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা গেছেন। এর আগের বছর মারা গিয়েছিলেন ২ হাজার ৬৭ জন। দুর্ঘটনার সংখ্যা গড়ে ২ হাজার।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেন সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নামে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড মহামারি আকার ধারণ করেছে। ইরাক বা আফগানিস্তানের ভয়াবহ যুদ্ধে যে প্রাণহানি হয়েছে, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা পরিস্থিতি তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু বিষয়টি যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। গণমাধ্যমগুলোও প্রাণহানির সংখ্যা বেশি না হলে বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত না হলে সংবাদ প্রকাশ করে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি দেশের ১০টি জাতীয় দৈনিক, ছয়টি স্থানীয় সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলসমূহে প্রচারিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ পর্যবেক্ষণ শেষে এই প্রতিবেদন তৈরি করে। সংগঠনটির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১ হাজার ৮০ জন ছাত্রছাত্রী, ৩০৫ জন শিক্ষক, ১৩৩ জন সাংবাদিক, ১০৯ জন চিকিৎসক, ১২৪ জন আইনজীবী, ১০৬ জন প্রকৌশলী, ৫৩৫ জন পরিবহনশ্রমিক, ৪১৯ জন চালক ও ২৮০ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য (পুলিশ, সেনাসদস্য, বিজিবি ও আনসার সদস্য) এবং ২ হাজার ২৪১ জন পথচারী রয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশের কাছে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে অভিযোগ বা মামলা করেও প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা মেলে না। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়ান না বিত্তবানেরাও। এই অবহেলা-অবজ্ঞার মাঝে দিন দিন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। বাড়ছে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা, যা মধ্যম আয়ের দেশে যাত্রার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। মেধাবী ও কর্মক্ষম জনসম্পদ হারিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির দেড় থেকে ২ শতাংশ।
সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ফুটপাত দখল, ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোড, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, গাড়ির ত্রুটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ক্রসিংয়ে জেব্রা ক্রসিং না থাকা এবং জেব্রা ক্রসিং গাড়িচালক কর্তৃক না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করা, মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যান একই সঙ্গে চলাচল, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো এবং মহাসড়ক ক্রসিংয়ে ফিডার রোডের যানবাহন উঠে যাওয়াই দায়ী।
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ যানবাহনের মধ্যে ফিটনেসবিহীন যানবাহন রয়েছে ৩ লাখের বেশি। আর যেসব যানবাহনের ফিটনেস আছে, সেগুলোও যথাযথভাবে নেওয়া হয় না। কারণ, ৪০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি যানবাহনের সনদ দেওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ খালি চোখে একটু দেখেই ফিটনেস দিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিটনেস সনদ দেওয়ার যন্ত্র বিকল হয়ে আছে এক যুগ ধরে।
দেশে চালকের লাইসেন্স আছে সাড়ে ১৫ লাখ। এরও একটা বড় অংশ দেওয়া হয়েছে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া, শ্রমিক ইউনিয়নের দেওয়া তালিকা ধরে। অর্থাৎ প্রায় আট লাখ যানবাহনের কোনো চালক নেই। অথচ বাণিজ্যিক যানবাহনের প্রতিটির জন্য দুজন চালক দরকার হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বঙ্গবন্ধু সেতু দুর্ঘটনা ঘটে কুয়াশার কারণে। কুয়াশায় ক্ষেত্রবিশেষে যান চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। আর একান্তই চালাতে হলে ১০ কিলোমিটারের কম গতিতে চালানো উচিত। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের এবং গাড়িচালকের। তবে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা হয়নি। এ জন্যই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
সামছুল হক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে প্রতিবছরের জন্য আলাদা লক্ষ্য ঠিক করে কর্মসূচি নিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁর জানা নেই।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাটবাজার অপসারণ করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ ১০ দফা সুপারিশ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরামের মহাসচিব খাইরুজ্জামান কামাল, নিরাপদ সড়ক চাই-এর যুগ্ম মহাসচিব গণি মিয়া, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সমন্বয়ক মহিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।