৪০ বছরের বেশি বয়সী আবিরন বেগম দেশে ফিরেছেন কাফনে মোড়ানো লাশ হয়ে। মেয়ে আবিরন ফেরায় বৃদ্ধ বাবা আনছার সরদারের নামে ৩৫ হাজার টাকার একটি চেক ইস্যু হয়েছে। আবিরনের বোন রেশমা খাতুন ও স্বজনেরা আবিরনের লাশ নিয়ে রওনা দিয়েছেন খুলনায় বাড়ির পথে। বৃদ্ধ মা–বাবা অপেক্ষায় আছেন মেয়েকে দেখবেন বলে।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো শাখায় আবিরনের লাশ হস্তান্তরপ্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রায় ১০টা নাগাদ বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে রেশমা বেগম মৃত বোনের লাশের জন্য বাবার নামে ইস্যু করা চেক হাতে নিয়ে বিমানবন্দর ছাড়লেন। আবিরনের মৃত্যুসনদে মৃত্যুর কারণের জায়গায় লেখা আছে ‘মার্ডার’ বা হত্যা।
২০১৭ সালে আবিরন সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়েছিলেন। রেশমা বলছিলেন, তাঁরা ছয় বোন। আবিরন ছিলেন মেজ। আবিরনের বিয়ে হলেও সন্তান হয়নি বলে স্বামীর সঙ্গে ঘর করা হয়নি। সেও প্রায় ২০ বছর আগের কথা। তারপর থেকে আবিরন ছিলেন মা–বাবা ও বোনদের সঙ্গে। আবিরন বিদেশ গিয়েছিলেন বোনদের পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ জোগাতে। আবিরনের চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। বিদেশ থেকে তাঁর পাঠানো টাকায় পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। তাই রেশমা এবং অন্যদের আপত্তি না শুনে শুনেছিলেন দালালদের কথা। আর এখন ফিরলেন লাশ হয়ে। লাশ হয়ে দেশে ফিরতেও সময় লেগেছে সাত মাস। এত দিন সৌদি আরবের রিয়াদের একটি হাসপাতালের মর্গে ছিল আবিরনের লাশ।
রেশমা বললেন, ‘প্রথমে শুনছিলাম অ্যাকসিডেন্ট করে বোন মরছে। পরে শুনি তারে গুলি করে মারছে। আর যেন কোনো নারীশ্রমিককে বিদেশে নিয়োগ দেওয়া না হয়। নিয়োগ দিলে তো লাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে।’ তিনি জানালেন, আবিরন যাওয়ার পর মাত্র ১৬ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। আর কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি।
রেশমার স্বামী এস এম আইয়ুব আলী জানালেন, সরকারের পক্ষ থেকে এর আগে একবার জানানো হয়েছিল, আবিরনের লাশ দেশে এসেছে। তখন তাঁর স্ত্রী ওই লাশ দেখেন। তবে সেই লাশ ছিল অন্য নারীর। শুধু নামটাই মিল ছিল আবিরনের সঙ্গে।
এস এম আইয়ুব আলী বললেন, ‘ওই সময় লাশ দেখার পর আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবার আর লাশ খুলে দেখতে চাচ্ছেন না। এবার নাম, ঠিকানা সব তথ্য ঠিক আছে। তাই একেবারে বাড়ি গিয়ে লাশের মুখ দেখবেন স্ত্রী।’
বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা গৃহকর্মীদের বিমানবন্দরে বিভিন্ন সহায়তা করা ও গৃহকর্মীদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করাসহ বিভিন্ন কাজে সহায়তা করছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি। আজ ভোর থেকে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের এই কর্মসূচির পক্ষে তথ্য কর্মকর্তা আল-আমিন। তিনি বলেন, চলতি বছরের এই পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে দেশে ফিরেছেন প্রায় ৮৫০ জন নারীশ্রমিক। আর চলতি বছর এই পর্যন্ত ১১৮ জন নারীশ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে।
আল–আমিন জানালেন, শুধু নারীশ্রমিক বিদেশে পাঠানোর জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৬২১টিতে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নারীশ্রমিকেরা বিদেশে কোনো নির্যাতনের শিকার হলে বা মারা গেলে তখন আর এজেন্সি তার দায়দায়িত্ব নিচ্ছে না। অভিযুক্ত কোনো এজেন্সিকে সরকার আইনের আওতায় কঠোর শাস্তি কার্যকর করেছে, তারও নজির নেই।
রেশমা জানালেন, গত মার্চ মাসে আবিরনের সঙ্গে শেষ কথা হয়। তখনই তিনি বলেছিলেন, তিনি মনে হয় আর দেশে ফিরতে পারবেন না। এর আগে কয়েক মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ পেতেন আবিরন। ফোন রেকর্ড শুনে আবিরনকে পেটাত, তাই সব কথা বলতেও পারতেন না। তবে আকার-ইঙ্গিতে যা জানিয়েছেন, তাতে ওই বাসায় মোট আটজন পুরুষ থাকতেন। তাঁরা আবিরনকে যৌন নির্যাতনও করতেন। এর বাইরে খাবার খেতে না দেওয়া, গ্রিলে মাথা ঠুকে দেওয়াসহ নানান নির্যাতন তো ছিলই।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) বরাবর লেখা গত ১১ সেপ্টেম্বরের এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের ২৪ মার্চ আবিরন মারা যান। আর আবিরনের লাশ দেশে আনতে খরচ হবে বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ৬১ হাজার ১৬১ টাকা। চিঠিতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে দূতাবাসের অনুকূলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ‘মৃতদেহ দেশে প্রেরণ বাবদ খাত’ এ বরাদ্দ করা বাজেট থেকে এই ব্যয় করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ এ আবিরনের মৃত্যুর তারিখ লেখা আছে চলতি বছরের ১৭ জুলাই। সরকারি কাগজপত্রে আবিরন যে এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশ গিয়েছিলেন, তার নাম ফাতেমা এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিস। রাজধানীর কাকরাইলে অফিসের ঠিকানা দেওয়া আছে।
আবিরনের বোন রেশমা বলেন, আবিরন কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যান, তা তাঁরা জানতেন না। দালাল হিসেবে কাজ করা রবিউল এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মী নিপুন গাইনের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। তাঁদের জানানো হয়েছিল, আবিরন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। তবে রেশমা অভিযোগ করে বলেন, এই দুজন সব সময় বলতেন, দুই বছর পর চুক্তি শেষ হলে আবিরন দেশে ফিরবেন। আর তাঁকে ফিরিয়ে আনতে ৭০ হাজার টাকা লাগবে। তারপর আবিরনের মৃত্যুর পর লাশ দেশে আনার কথা বললেও তা শোনেননি। উল্টো এই নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরিবারের ক্ষতি করার হুমকি দেন।
তবে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত নিপুন গাইন বলেন, তিনি রবিউল এবং আবিরন দুজনকেই চেনেন। রবিউল বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর স্ত্রীকে বিদেশ পাঠান তখন তিনি সহায়তা করেন। এখন রবিউল পরিচিতদের বিদেশ যেতে সহায়তা করেন। আর বিদেশ যাওয়ার আগে আবিরনের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেছেন, বিদেশে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তা জানার পর আবিরনের স্বজনদের একটি দরখাস্ত লিখে দেওয়ার ক্ষেত্রেও সহায়তা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত আবিরন মারা যান সে খবর পেয়েছেন। এর বাইরে তাঁর আর কোনো সম্পর্ক ছিল না।
বিমানবন্দরে কার্গো শাখায় সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের কর্মকর্তারা বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা লাশের নথি পরীক্ষা করে, স্বজন বা ওয়ারিশ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ৩৫ হাজার টাকার চেক তুলে দেন স্বজনদের হাতে। এই ডেস্কের উপসহকারী পরিচালক মো. মাইন উদ্দীন জানালেন, কোনো কর্মীর লাশ ফেরত এলে লাশ পরিবহন ও দাফনের জন্য ৩৫ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়। এরপর বৈধ কর্মী হলে স্বজনদের ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। আর লাশ পরিবহনের জন্য স্বল্প খরচে অ্যাম্বুলেন্স সরবরাহ করা হয়।