চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। কর্মীদের আগুন নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণও ছিল না। ডিপোতে রাসায়নিক আলাদা করে রাখার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয়নি। এভাবে ডিপো ব্যবস্থাপনায় কর্তৃপক্ষের ছিল নানা গাফিলতি।
সোমবার ও রোববার এই ডিপো সরেজমিন ঘুরে, আগুন নিয়ন্ত্রণে যুক্ত থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা এবং ডিপোর শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, ডিপো তৈরির নীতিমালায় ফায়ার হাইড্রেন্ট রাখতে বলা হয়েছে। তবে বিএম কনটেইনার ডিপোয় ঘুরে কোথাও তা দেখা যায়নি। ফায়ার হাইড্রেন্ট হলো পানি সংরক্ষণাগারের সঙ্গে সংযুক্ত বিশেষ পানিকল। এই কলের সঙ্গে নল যুক্ত করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরাসরি এই পানি আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করতে পারেন।
ডিপো শ্রমিক ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জানান, গত শনিবার রাতে ডিপোতে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আনা পানি শেষ হলে দূরের পুকুর থেকে পানি এনে ছিটাতে হয়েছে। সেখানে ডিপোর ভেতর ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলে তা সহজ হতো।
আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যুক্ত থাকা ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জানান, আগুন নেভানোর জন্য ডিপোতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছিল নামেমাত্র। এগুলো পর্যাপ্ত সংখ্যায় থাকলে হয়তো আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যেত।
সরেজমিন ডিপোর ভেতর দেখা যায়, ১০ থেকে ১২টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার পড়ে আছে। অথচ ২৪ একর জায়গার ওপর নির্মিত এ ডিপোতে শতাধিক ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকার কথা বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। রোববার দুপুরে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের ওয়্যারহাউস পরিদর্শক ওয়াসি আজাদ বলেন, পর্যাপ্তসংখ্যক ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলে হয়তো এত ভয়াবহ ঘটনা ঘটত না।
শ্রমবিধিতে বলা আছে, ৫০ জনের বেশি জনবলের কোনো কারখানা হলে সেখানে একটি নিরাপত্তা (সেফটি) কমিটি থাকবে। কারখানার শতকরা ছয়জন আগুন নেভানোর জন্য, ছয়জন উদ্ধারের জন্য এবং ছয়জন প্রাথমিক প্রতিবিধানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। অর্থাৎ ১৮ শতাংশ প্রশিক্ষিত কর্মী থাকবে। কিন্তু বিএম কনটেইনার ডিপোতে প্রশিক্ষিত কোনো কর্মী ছিলেন না। কমিটি ছিল নামমাত্র। গত দুই দিন ডিপোর প্রায় ৩০ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা আগুন নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণের বিষয়ে কিছুই জানেন না।
বিএম কনটেইনারের ডিপোর ফটকের সামনে সোমবার দুপুরে কথা হয় সেখানকার পরিবহন ব্যবস্থাপক হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগুনের বিষয়ে আমাদের কোনো কিছুই বলা হয়নি। প্রশিক্ষণ কেন নেব?’
ডিপোর পাশে তিন বছর ধরে মুদিদোকান চালান এক যুবক। তাঁর দোকান থেকে ডিপোর ভেতরে দেখা যায়। ওই দোকানদার প্রথম আলোকে বলেন, ডিপোর ভেতর কখনো অগ্নিনির্বাপণের মহড়া হতে দেখেননি। ডিপোর শ্রমিকেরা জানান, অনেক আগে একবার আগুন নির্বাপণের মহড়া হয়েছিল। সর্বশেষ কবে হয়েছে মনে করতে পারছেন না।
গত শনিবার রাতে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকায় এই ডিপোতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছুটে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে আগুন ছড়িয়ে রাসায়নিকের কনটেইনারে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অন্তত ৪১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন সদস্য রয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে কী ধরনের দাহ্য পদার্থ কনটেইনারে আছে, তা লেখা থাকবে। কিন্তু বিএম ডিপোতে থাকা হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের কনটেইনারে এসবের কিছুই ছিল না।
ডিপোটি নীতিমালা অনুসরণ করে চলছিল কি না, সে প্রশ্ন করা হয়েছিল কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিবকে। তিনি সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর ২৮ ডিসেম্বর তাঁরা বিএম ডিপো পরিদর্শন করেন। সেখানে বেশ কিছু ত্রুটি ধরা পড়েছিল। এসব ত্রুটি নিরসনে পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (বিডা) সুপারিশ পাঠিয়েছিলেন। তবে পরে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তা আর জানেন না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ঢাকার সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো. মনির হোসেন রোববার থেকে ডিপোতে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল না। থাকলে সহজে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যেত। ডিপোর গুদামে রাসায়নিক বস্তু আলাদা রাখার নিয়ম রয়েছে। কনটেইনারের ওপর ম্যাটেরিয়াল সেফটি ডেটা শিট থাকার কথা। কিন্তু তাঁরা যেসব কনটেইনার দেখেছেন, সেগুলোতে তা ছিল না।
ডিপো পরিচালনাকারীদের গাফিলতি ছিল কি না, সে প্রশ্নের জবাবে মনির হোসেন বলেন, ব্যবস্থাপনা দুর্বল ছিল। প্রশিক্ষিত কর্মী ছিল বলে মনে হয় না।
নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ বিনিয়োগে বিএম কনটেইনার ডিপো গড়ে ওঠে। এখানে বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপের অংশীদারি রয়েছে। যে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের রাসায়নিক পদার্থ থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেটিও স্মার্ট গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুনঃ
পোশাক, এলপিজি ও খাদ্যপণ্য খাতে বিনিয়োগ রয়েছে স্মার্ট গ্রুপের। এই কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিএম কনটেইনার ডিপোর চেয়ারম্যান বার্ট প্রঙ্ক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন মোস্তাফিজুর রহমান। পরিচালক হলেন স্মার্ট জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান। মুজিবুর সম্পর্কে মোস্তাফিজুরের ভাই। মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে আছেন। গত সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম–১৬ (বাঁশখালী) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। তবে তাতে সাড়া দেয়নি দল।
মোস্তাফিজুর ও মুজিবুর রহমান দুই ভাইয়ের কেউ এখনো ঘটনাস্থলে আসেননি। তাঁদের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলছেন সাবেক ডিআইজি প্রিজনস সামছুল হায়দার সিদ্দিকী। তিনি সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমরা হতাহতের চিকিৎসা ও সহায়তা নিয়ে আছি। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসুক। তখন ডিপোতে থাকা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারব এখানে কী ছিল আর কী ছিল না। আমরাও চাই সুষ্ঠু তদন্ত হোক।’