কথা বলার লোক পেলে হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেন না আবু মহসিন: অধ্যাপক কামাল চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণার কাজ করেছেন। তিনি ফেসবুক লাইভে এসে ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার ঘটনা, এর কারণ ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

অধ্যাপক কামাল চৌধুরী
প্রশ্ন

প্রথম আলো: ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের বেদনাদায়ক আত্মহত্যার ঘটনা আলোড়ন তুলেছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র। একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল? আপনি দেখেছেন ভিডিওটি?

কামাল চৌধুরী: আমি দেখিনি। আর যাতে মানুষ এটি না দেখে, সেই অনুরোধ জানিয়ে আমার ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছি। এর কারণ হলো, এটা দেখার ফলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আমি ঘটনার বিবরণ যতটা পড়েছি, সেসব বিষয় মানুষ হয়তো সিনেমা বা নাটকে দেখে। কিন্তু মানুষ যখন সেসব দেখে, তখন জানে যে এটা বাস্তব নয়। তাই সেটা তার মধ্যে ক্ষণিক ভীতির সঞ্চার করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না বা এর প্রভাব তেমন থাকে না। কিন্তু এ ঘটনা যখন মানুষ দেখবে, তখন সে নিশ্চিতভাবেই ট্রমায় আক্রান্ত হবে। কিছু মানুষ কৌতূহল থেকেই হয়তো দেখবে। আর দেখে তার মধ্যে ভীতি, আতঙ্কের সৃষ্টি হবে। আমি নিশ্চিত, অনেকের ঘুম হবে না। মহসিন সাহেবের মতো অবস্থানে বাংলাদেশের অনেক মানুষই আছেন। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষেরা। তাঁদের কথাই তিনি বলেছেন। অনেকেই সামাজিকভাবে, পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। তাঁদের সন্তানদের থেকে, পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে আঘাত পেয়েছেন। তাই এ ঘটনা দেখে তাঁরা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবেন। এটা থেকে তাঁরা নতুন ট্রমায় আক্রান্ত হবেন। আমি বলছি না যে এ ধরনের কাজ তাঁরাও করবেন। তবে কেউ কেউ এখান থেকে ধারণা লাভ করতে পারেন। এটা বিপজ্জনক বয়স্ক মানুষদের জন্য।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কেন তিনি এ পথ বেছে নিলেন বলে আপনার মনে হয়?

কামাল চৌধুরী: একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আমার ধারণা, আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার এ ঘটনা একটি স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা। এটা আমার ধারণা সত্যি না–ও হতে পারে। উনি কয়েক বছর ধরে কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছেন, বিশেষ করে করোনার পর বিচ্ছিন্নতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। এ সময়ে সে কথা তিনি কাউকে বলার লোক পাচ্ছিলেন না বা ওনার কথা শোনার মতো কেউ ছিলেন না। উনি ফেসবুকে লাইভের পথটা বেছে নিয়েছেন এ কারণে যে মানুষ তাঁর কথা শুনুক। স্বীকৃতি দিক। উনি যদি আত্মহত্যা না করেন, এমনি এমনি বলতেন, কেউ হয়তো তাঁর কথা শুনত না। উনি বেছে নিয়েছেন এমন একটা পথকে, যেটা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আর এটি সত্যিকারভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এটা নিয়ে মানুষ কথা বলেছে, আরও বলবে। তিনি তাঁর স্বীকৃতি পেয়েছেন বটে। তবে তিনি যে পন্থা বেছে নিয়েছেন, তা আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: উনি দীর্ঘ সময় কথা বলেছেন। এর মধ্যে তিনি তাঁর ব্যক্তিজীবনের কথা বলেছেন। কিন্তু এ ঘটনার একটি সামাজিক দিকও তো আছে। তিনি তো এসব সামাজিক অভিঘাতের শিকার হয়েছেন বলেই মনে হয়েছে। এ বিষয়গুলো কি এড়ানো যেত না?

কামাল চৌধুরী: উনি প্রায় ১৬ মিনিট ধরে কথা বলেছেন। এসব কথা কাউকে বলার মতো কেউ কি ছিল না? উনি বুঝে গিয়েছিলেন, এসব কথা শোনার মতো কাছের কেউ নেই। তিনি কথা বলা শেষ করলে কেউ এটা শুনত না, সেটাও উনি বুঝেছিলেন। যদি কেউ তাঁকে সময় দিত বা আবু মহসিন যদি কোনো কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলতেন, যদি কোনো পেশাদার মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলতেন, তবে আমি নিশ্চিত, এ পথ তিনি বেছে নিতেন না। এ হতাশার মধ্যেও জীবনের একটি আশার পথ পেতেন। উনি কথা বলতে পারেননি। কোনো স্বীকৃতি তিনি চেয়েছিলেন, কিন্তু সে পথ ভয়ানক।

অধ্যাপক কামাল চৌধুরী
প্রশ্ন

প্রথম আলো: তাঁর কথাবার্তার মাধ্যমে মনোসামাজিক কোন দিকটি আপনার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে?

কামাল চৌধুরী: তাঁর কথায় নিঃসঙ্গতার কথা বারবার ফুটে উঠেছে। তাঁর খালার কথা এসেছে। তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন। পরিবারের সন্তানদের কথা বলেছেন। পুরুষদের অর্থ উপার্জনের বেশির ভাগ খরচ হয় পরিবারের জন্য। সেটা উনিও করেছেন বলেছেন। কিন্তু এরপর হতাশার বিষয় এসেছে। নিজের জন্য কিছু না করে বিনিময়ে কিছু পাননি। এটা অনেকের মধ্যে, অনেক বয়স্ক মানুষের মধ্যে আছে। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে এই বার্তা এসেছে, পরিবারের যেসব বয়স্ক ব্যক্তি আছেন, তাঁদের সময় দেওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে তাঁদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তার কথাও ভাবতে হবে। বিশেষ করে যাঁরা একা থাকেন, তাঁদের ঝুঁকিটা বেশি। এই করোনাকালে এ কথা বেশি করে সত্য। আবু মহসিন খানের মতো মানুষেরা এই প্রজন্মের নন। তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতে পারেন না। পছন্দ করেন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, কাছে যেতে। এই করোনাকাল তাঁদের সেই পথ রুদ্ধ করেছে। বড় একটি বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। তাঁরা কোথাও যেতে পারেন না, তাঁদের কাছে কেউ আসতে পারেন না। তাঁর মধ্যে উনি ক্যানসার রোগী ছিলেন। এ ধরনের মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সমাজ-অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে পরিবারের কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে। এটা বাস্তবতা। এখানে আমরা নাগরিক দায়িত্ব পালন করছি কতটুকু। পরিবারগুলো কতটা করছে। আমি মহসিন খানের পরিবারকে উল্লেখ করে বলছি না। সার্বিকভাবে যদি প্রশ্নটি আসে, তবে এর জবাব কী হবে?

কামাল চৌধুরী: আমিও তাঁর পরিবারকে দোষী সাব্যস্ত করছি না। সময়ের বাস্তবতাই এমন। এখন বাংলাদেশের মানুষ বাইরে যাচ্ছেন উন্নত জীবনের জন্য, পেশার পরিবর্তনের জন্য। স্থায়ীভাবে কেউ যাচ্ছেন। এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কিছু মানুষের মধ্যে এর ফলে একাকিত্ব তৈরি হবে। বয়স্ক মানুষদের অনেকের পক্ষে বিদেশে গিয়ে মানিয়ে নেওয়াটা মুশকিল। অনেকে যান, দেখা যায়, আবার ফিরেও আসেন। এই বাস্তবতায় আমাদের নাগরিক দায়িত্ব হলো, এসব মানুষের বিনোদনের বা সময় কাটানোর সুব্যবস্থা করা।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থা কতটুকু আছে?

কামাল চৌধুরী: খুব বেশি নেই। যতটুকু আছে, করোনার কারণে সেই পরিবেশ আরও সংকুচিত হয়েছে। তাঁরা ভয় পান। বয়স্ক মানুষের করোনায় সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। এই দুই বছরে তাঁদের বাইরে বের হওয়া বা সামাজিক যোগাযোগের পরিবেশ আরও সংকুচিত হয়েছে। আমাদের দেশে এসব মানুষের জন্য মনোসামাজিক সহযোগিতার জন্য হটলাইন চালুর দরকার। যেখানে মানুষ তার কথা বলতে পারে, নিজেকে হালকা করতে পারে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগেই এটা হতে পারে। এটা ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর ক্রাইসিস হটলাইনের ব্যবস্থাও থাকা দরকার, যেখানে আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা বা এর ইচ্ছা পোষণকারীরা চাইলে কথা বলতে পারেন, এর প্রতিরোধে সহযোগিতা চাইতে পারেন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ‘কান পেতে রই’ নামের একটি পরিষেবা আছে।

কামাল চৌধুরী: হ্যাঁ, এটা সার্বক্ষণিক নয়। তবুও আছে। কিন্তু এ ধরনের সেবা সরকারি স্তরে ও সার্বক্ষণিকভাবে থাকা দরকার।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আত্মহত্যা প্রতিরোধে এ–সংক্রান্ত তথ্য প্রচারের গুরুত্বটা কতটুকু? কারণ, দেশে প্রতিবছর এটি বাড়ছে।

কামাল চৌধুরী: আমি শিক্ষার্থীদের স্তরে এ–সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার পক্ষপাতী নই। তাদের জন্য যেটা করা যায়, তাদের পড়ালেখার বোঝা কমাতে হবে। প্রচণ্ড চাপে তারা হতাশায় পড়ে, মনোবল দুর্বল হয়ে যায় এবং এভাবে দুর্বল মনোভাবের মানুষ হয়ে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর বিপরীতে আত্মহত্যাসংক্রান্ত তথ্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের অনেক বেশি জানতে হবে। তাঁরা এর প্রতিরোধে কাজ করতে পারবেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এমন সমস্যা দেখলে সচেতন হবেন। আর আমাদের কমিউনিটি পর্যায়ে যেসব স্বাস্থ্য পরিষেবা আছে, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় একেবারে উপেক্ষিত। সেখানে এগুলো জোরদার করতে হবে। আত্মহত্যা পুরোপুরি বন্ধ সম্ভব নয়। তবে প্রতিরোধ করা খুবই সম্ভব। এর জন্য চাই সবার সদিচ্ছা। আর সরকারি–বেসরকারি সব স্তরের উদ্যোগ।