কথাই হয়, কাজ হয় না

দুই বছরে দুবার আগুন লেগে পুরো দোকান পুড়ে যায় জহিরুল ইসলামের। এ কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। গতকাল গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের পাশে কাঁচাবাজারে। ছবি: প্রথম আলো
দুই বছরে দুবার আগুন লেগে পুরো দোকান পুড়ে যায় জহিরুল ইসলামের। এ কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। গতকাল গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের পাশে কাঁচাবাজারে।  ছবি: প্রথম আলো
>

*পাঁচ বছরে ৮৯ হাজার ৯২৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা
*অগ্নিকাণ্ডগুলোর মধ্যে ২৮ হাজার ১৩টি ঢাকায়
*প্রতিটি ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি গঠন হয়
*কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুপারিশ দেয় কমিটি
*সুপারিশের কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয় না

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের প্রাণহানির রেশ এখনো কাটেনি। এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণ গেছে আরও ২৬ জনের। গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের পাশের কাঁচাবাজারে গতকাল শনিবার আবারও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

একের পর এক এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অগ্নিনির্বাপণে স্থাপনাগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি এগুলো দেখভালে সরকারের সংস্থাগুলোর দায়িত্বে অবহেলার কথাও আসছে ঘুরেফিরে। আবার পরপর কয়েকটি আগুন লাগার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, ঘটনা ঘটার পর অনেক কথা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। সুপারিশ আসে অসংখ্য। চলে চিঠি–চালাচালি। তারপর একসময় সব থেমে যায়। কোনো কাজ হয় না। আবার আরেকটি অগ্নিকাণ্ড হলে তবেই শুরু হয় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

যেমন সর্বশেষ গতকালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস বলেছে, দুই বছর আগে ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি এই বাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর অগ্নিনির্বাপণে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সুপারিশ করেছিল তারা। এমনকি ব্যবস্থা নিতে চারবার নোটিশ দেওয়ার পরও তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যদিও এই কাঁচাবাজারটির দেখভালের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের।

গতকালের আগুন

গতকাল শনিবার সকাল পৌনে ছয়টায় ডিএনসিসি মার্কেটের পাশের কাঁচাবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ওই বাজারের ১৭৫টি দোকানের সব কটি পুড়ে যায়। পাশের মার্কেটের কয়েকটি দোকানেও আগুন ধরে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট প্রায় আড়াই ঘণ্টা কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিলীপ কুমার ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, এখানে এই মার্কেটে আগুন নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। কাজ করতে গিয়ে তাঁদের পানির স্বল্পতার মধ্যেও পড়তে হয়েছিল। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ভোরবেলা একই মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর অগ্নিনির্বাপণে ব্যবস্থা নিতে তিন থেকে চারবার মার্কেট কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ঘটনার পর অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক শামিম হাসানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে তাঁদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। আবার অগ্নিকাণ্ডের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলীকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ডিএনসিসি। এই কমিটি ৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে।

কেবল কথা আর দায়িত্ব এড়ানো

ফায়ার সার্ভিসের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ৮৯ হাজার ৯২৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮ হাজার ১৩টি ঘটনা ঘটেছে ঢাকা শহরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুপারিশ দেয় কমিটি। কিন্তু কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয় না।

দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএনসিসি মার্কেট ও কাঁচাবাজার মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা মো. হুমায়ুন সিদ্দিকী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনার পর তাঁরা পুরো মার্কেটে ১০টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বসিয়েছিলেন। এর বাইরে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন তিনি বলছেন, ফায়ার সার্ভিস যে ধরনের নির্দেশনা দেবে, তাঁরা সেভাবেই উদ্যোগ নেবেন।

এই কাঁচাবাজারটির দেখভাল করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশের বিষয়ে বাজার কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল কি না, জানতে চাইলে ডিএনসিসির সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বিষয়টি তিনি দেখভাল করেন না বলে জানান। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য তিনি প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সালেহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রথমে তিনিও সচিবের মতোই বিষয়টি তাঁর এখতিয়ারে নেই বলে দাবি করেন। এ বিষয়ে তিনি সচিবের সঙ্গে বা রাজস্ব বিভাগের প্রধানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কিন্তু সচিবই তাঁর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন এমনটা জানানোর পর তিনি বলেন, ২০১৭ সালের দুর্ঘটনার পর নিজেদের রুটিরুজির একমাত্র সম্বল বলে অনুনয় করে আবারও বাজার করার অনুমতি নিয়েছিলেন মালিক সমিতির লোকজন। কথা দিয়েছিলেন তাঁরা সব ধরনের ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু নেননি। এরপর বহুবার তাঁদের ব্যবস্থা নেওয়ার তাগাদা দিলেও তাঁরা কথা শোনেননি। আইনি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়টি তাঁর এখতিয়ারে নেই।

গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘মার্কেটটিতে এর আগে যখন আগুন লাগে, তখন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। এখনো অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা এখানে ডিএনসিসি স্থায়ী মার্কেট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মামলার জটিলতা আছে। আমরা এই মামলার নিষ্পত্তি করে যত দ্রুত সম্ভব স্থায়ী মার্কেটের দিকে যাব, যেখানে অগ্নিনির্বাপণসহ ব্যবসায়ীদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থাকবে।’

সক্ষমতা নেই ২০১ ভবনের

২০১৭ সালে ডিএনসিসির মার্কেটটিতে অগ্নিকাণ্ডের পর গুলশান, বনানী ও বারিধারার বাণিজ্যিক ভবন, ব্যাংকের কার্যালয় ও হাসপাতালের অগ্নিঝুঁকি নিরূপণ করে ফায়ার সার্ভিস। ভবনগুলোর ভূগর্ভস্থ জলাধারের ধারণক্ষমতা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ও প্রয়োজনীয় লিফটের উপস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তারা ওই এলাকার ভবনগুলো পরিদর্শন করে। পরবর্তী সময়ে তারা জানায়, এই তিন এলাকার ২০১টি ভবনের অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলার সক্ষমতা নেই। এর মধ্যে ৪৬টি বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে, যার ২১টি বহুতল ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করে তারা। বিভিন্ন ব্যাংকের ১০৮টি কার্যালয়ের মধ্যে ১০৪টিকে অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ১২টি হাসপাতালের মধ্যে ১০টিরই অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলার সক্ষমতা নেই বলে জানিয়েছিল তারা।

ডিএনসিসি কাঁচাবাজার ও সুপার মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরিদর্শনে গতকাল গিয়েছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। ফায়ার সার্ভিসের জরিপ অনুযায়ী এই এলাকার বেশির ভাগ ভবনে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা যে নেই, এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শুধু গুলশান–বনানী নয়, ঢাকা শহরের যেকোনো স্থানে যদি অপরিকল্পিতভাবে ইমারত নির্মিত হয়ে থাকে, অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা না থেকে থাকে, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবন তৈরির অনিয়মের সঙ্গে যারাই জড়িত হোক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মালিক হোক, ডেভেলপার হোক, এমনকি রাজউকের কোনো লোক জড়িত থাকলে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি তাদের হতে হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

মন্ত্রী বলেন, অতীতে অনেক তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু এবার সব তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে আনা হবে। মানবসৃষ্ট কারণে যদি কারও মৃত্যু হয়, তাহলে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।