‘কত হাজার মানুষের দাহ করেছি, বাবার মরদেহ পাইনি’  

ফরিদপুরের এই শ্মশানে হাজারো মানুষের শেষকৃত্য হয়েছে কানুদা নামে পরিচিত সমরেন্দ্র নাথ সেনের হাতে
ছবি : প্রথম আলো

কানুদা নিজেকে বয়স্ক মানুষ ভাবতে মোটেই পছন্দ করেন না। তাই যে কাজ পারেন না, জোর করে সেটাও করে দেখাতে চান। পা তুলতে খুব কষ্ট কিন্তু অটো বাদ দিয়ে উঁচু রিকশায়ই উঠতে যান। দাঁড়ালে শরীর ঝুঁকে যায় কিন্তু হুট করেই হেঁটে রওনা হন দূরের পথে। তিনবেলা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাজাপোড়া খেয়ে যাচ্ছেন অবলীলায়।

ফরিদপুর শহরের মূল সড়কগুলো দিয়ে যে আমলে ঘোড়ার গাড়ি বা মহিষের টমটম চলত, সে সময়ের কথা তাঁর খুব মনে আছে। মন্বন্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধ, দেশভাগ থেকে পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা—সব ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে কানুদার জীবন। কিশোর বয়সে ওপার থেকে এপারে এসেছেন, আবার যুবক বয়সে শরণার্থী হয়ে গেছেন সে দেশে।

মরদেহ কাঁধে নিয়ে ছুটেছেন শহরের এ মাথা থেকে সে মাথা পর্যন্ত। পঞ্চাশের দশকে একবার শহরের মানুষ যখন কলেরার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন কিশোর কানুদা তিন রাত তিন দিন সরেননি শ্মশান থেকে। রেললাইন পার হয়ে হাতের বাঁয়ে লক্ষ্মীপুরের পরিত্যক্তের মতো এক জায়গায় শহরের লাশকাটা ঘর। সেখানে এখনো দিনের বেলা গা ছমছমে অন্ধকার।

দেশভাগ থেকে সব রাজনৈতিক সংকটকালে দুই বাংলায় আশ্রয় নেওয়ার গল্প রয়েছে তাঁর

প্রায় পাঁচ যুগ আগে সে ঘর থেকে চার দিনের বাসি–পচেগলে যাওয়া মরদেহ এক বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে গেছেন শ্মশানে। চৌরঙ্গীর মোড় থেকে ডানে এগোলে বহুকালের পুরোনো দুই ভবনের মধ্যে দিয়ে এক শব্দহীন গলিপথ। শীতের রাতে সে পথে দু–একটা বিড়াল ছাড়া প্রাণের শব্দ নেই। হাঁটতে হাঁটতে কানুদা নিজের ফেলে আসা সময়ের গল্প বলছিলেন। যেন স্বগতোক্তির মতোই আওড়ালেন, ‘মানুষের আসল স্বজন বিদায়ের সময় বোঝা যায়। কত বর্ণিল জীবনের শেষবিদায়টা অনাদরে হলো দেখলাম! কিন্তু সব মৃতজনই শেষ আয়োজন যথাযথ শ্রদ্ধার সঙ্গে পাওয়ার অধিকার রাখে।’

মাত্র ছয় বছর বয়সে হুগলি নদীঘেঁষা দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে দেখতেন খাগড়া শ্মশানে রাত–দিন জ্বলছে চিতা। তখন মন্বন্তরের সময়। কখনো কখনো সাঁতরে নদী পার হয়ে গিয়ে উঠতেন শ্মশানে। ঘুরে ঘুরে দেখতেন দাহের প্রক্রিয়া। ভয় ভেঙে যায় শৈশবেই। তখন কানুদা থাকতেন মা–বাবার সঙ্গে পৈতৃক বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। তাঁদের বাড়ির কাছের হুগলি নদী তখন ছিল খরস্রোতা।

পৈতৃক নাম মুছে গেছে সবার কানুদা সম্বোধনে

তবে তাঁর জন্ম হয়েছিল নানাবাড়ি এপার বাংলার ফরিদপুরে। গোয়ালন্দ পর্যন্ত ট্রেনে আসা যেত। সেখান থেকে আবার ট্রেন বদলে ফরিদপুর শহর কয়েক মিনিটের পথ। ’৪৭–এর দেশভাগের পর পুরোপুরি থিতু হতে হলো ফরিদপুরে। শৈশবের সে শ্মশানের স্মৃতি তাঁর পিছু ছাড়ল না। ফরিদপুরের গোবিন্দপুরের শ্মশান পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের বাড়ির পাশে। কবির বড় ছেলের সহপাঠী কানুদা। নিজে যখন শ্মশানে বসে থাকতেন, তখন কবি জসীমউদ্‌দীনকেও দেখেছেন সেখানে বসে গান, কবিতা লিখতে। অতটুকু বয়সেই শ্মশানের প্রতি এত টান কেন তাঁর হয়েছিল, জানতে চাইলে বললেন দাঙ্গার গল্প।

১৯৪৭ সালের আগস্টের এক দুপুরে বহরমপুরের বাড়িতে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন কলকাতার বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী শৈলেন্দ্র নাথ সেন। এরপর বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন কলকাতাগামী ট্রেন ধরতে। পৌঁছে খবর পাঠানোর কথা ছিল বাড়িতে। চারপাশে তখন দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। তিন–চার দিনেও কোনো খবর না পেয়ে ১৩ বছরের ছেলে বহরমপুর থেকে লোকাল ট্রেনে চড়ে এসেছিলেন ভবানীপুরে বাবার মেস বাড়িতে। শুনলেন শৈলেন্দ্রনাথ পৌঁছাননি সেদিন। শৈলেন্দ্র নাথ আর কোনো দিন পৌঁছাননি সন্তানের কাছে। সেদিন শূন্য হাতে বাড়ি ফিরেছিল ছেলেটি। চারপাশে তখন শুধু আতঙ্কের ছায়া। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ। একদল ওপার বাংলা থেকে আসছে তো আরেক দল তাদের দালানকোঠা সব ফেলে পাড়ি দিচ্ছে ওপারে।

টিনের ঘরের সামনে পাহারা দেয় এক শিশু নিমগাছ

মন্বন্তরের চার বছর পর বহরমপুরের দোতলার জানালার পাশে বসে থাকতে থাকতে দেখেছিল খাগড়া শ্মশানে চিতা জ্বলছে যেন অসমাপ্ত হয়ে। মরদেহের সংখ্যা এত বেশি যে চিতা আর নেভে না যেন। নিজের বাবার জীবনটাও একটা অসমাপ্ত অধ্যায়ের গল্প হয়ে গেল তাঁর জীবনে। একসঙ্গে বসে ভাত খাওয়া মানুষটা কিছুক্ষণ পরই হামলার শিকার হলে শেষ মুহূর্তে সন্তানের মুখটা মনে করেছিল কি না, ভাবেন কানুদা। সে দেহ কোন স্তূপের ভেতর মিশে গেল জানা যায়নি। কিশোরের ইচ্ছে হয়েছিল, শাস্ত্র মেনে বাবার মুখাগ্নি করার। প্রতিটি মরদেহের দাহ হলেই বাবার জন্য তাঁর চোখ ভরে যেত পানিতে।

কিশোরটির মা প্রতিভা রানী সেনের বয়স তখন ২৮ বছরের মতো। কদিন পরই বুঝলেন, ফরিদপুরে পিত্রালয়ই এখন নিরাপদ আশ্রয়। একমাত্র সন্তান নিয়ে চলে এলেন এপার বাংলার ফরিদপুরে। এ শহরের সবার মুখে তিনি বকুলদি।

ফরিদপুর মফস্বল শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রেশ প্রকট হয়নি। তবে মারি ও মড়কে তখন প্রায়ই মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে লাফিয়ে। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরের হজরত বাল মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উত্তাপ। ফরিদপুরের তৎকালীন নেতারা পরিবারসহ কানুদাকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে আসেন ভারত সীমান্তে। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার ফিরে আসেন।

কতবার দায়ে ঠেকে মৃতের আপনজনেরা এসেছে। হয়তো ঝড়–বৃষ্টি হচ্ছে, কেউ রাজি হচ্ছে না। হত্যা বা আত্মহত্যার মরদেহ পড়ে আছে কয়েক দিন ধরে লাশকাটা ঘরে। সেলাইগুলো হাঁ হয়ে আছে। সেই দেহ পাটিতে মুড়ে, বাঁশে ঝুলিয়ে রওনা হয়েছি।
এই শ্মশান চার দশক আগেও ছিল নদীর ওপাশে

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই আবার শরণার্থী হয়ে গেছেন ভারতে। শিবিরে নাম নিবন্ধন করিয়ে মাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বহরমপুরের বাড়িতে। সে যাত্রায় দেশভাগের ২৪ বছর পর আবার গিয়েছিলেন ভবানীপুরে বাবার কর্মস্থলে। দুই যুগ পরও তাঁকে দেখেই চিনেছিলেন বাবার সেই পুরোনো সহকারী। শিয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত সঙ্গে আসা মানুষটির কথা বলার সময় কানুদার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ফিরে আবার শুরু হলো তাঁর শ্মশানযাত্রা। শুধু শ্মশান নয়, অন্য ধর্মের মানুষের মৃত্যুর খবর পেলেও তিনি উপস্থিত হন। কারও বাড়িতে শ্রাদ্ধর রান্না, কোনো বাড়ির মেয়ের বিয়েতে তদারকি করতে হবে—সবখানেই আছেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে কলেরার সময়ের কথা জানতে চাই। বললেন, কলেরায় এত বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল যে একেকটি চিতায় একটি মরদেহ সম্পূর্ণ দাহ হওয়ার আগেই আরেকটি দেহ তুলে দিতে হচ্ছিল। আমারও যেন কেমন এক নেশা পেয়ে গেল। মনে হলো, যতক্ষণ পারি সব দেহ যথাযথ প্রক্রিয়ায় দাহ করেই বাড়ি ফিরব। রাতে এসে কেউ খানিকটা গুড়, চিড়া দিয়ে যেত। সারা দিনে ওই একবার খাওয়া। পাশ দিয়ে বইছে পদ্মার শাখা কুমার নদ। সুযোগ পেলে সেখানে শরীর ধুয়ে আসি। ফিরেই আবার হয়তো চিতায় তুলে দিতে হয় একটা মরদেহ। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে মৃতদেহের মুখ ভালো করে দেখার অবকাশও নেই। কখনো কখনো আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর চিতা জ্বলে উঠলে আগুনের ভেতর তাকিয়ে দেখেছি পরিচিত কেউই চলে যাচ্ছে। শ্মশান তখন ছিল নদীর ওপাশে গাছপালার ভেতর। বড় মন্দির ছিল। নদীভাঙন আর অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে এক রাতের মধ্যে মন্দিরসহ বসে গেল শ্মশান। ১৯৮৩ সালের দিকে সরিয়ে আনা হলো নদীর এই পাশে। এই তো সেদিনের কথা।

মানুষের আসল স্বজন বিদায়ের সময় বোঝা যায়। কত বর্ণিল জীবনের শেষ বিদায়টা অনাদরে হলো দেখলাম!

মন্বন্তর, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যার স্পষ্ট, সেই কানুদার কাছে এসব ঘটনা সেদিনের হওয়াই সম্ভব। তবে মফস্বল শহর ফরিদপুরের সব প্রজন্মের মানুষের মুখে পরিচিত এই কানুদার একটি ভালো নাম আছে। ১৯৩৪ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া সমরেন্দ্র নাথ সেনই হলেন কানুদা।

৮৯ বছর বয়সী মানুষটি মৃত্যুর খবর পেলেই ছুট দেন। অন্তত কিছুদিন আগেও তাই করতেন। মৃতের ধর্মপরিচয় মানেন না। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে আপনি সব করত পারেন কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রে ভূমিকা কী থাকে জানতে চাইলে বললেন, ‘এমন কোনো ধর্ম আছে যেখানে মানুষের শেষযাত্রাকে গুরুত্বহীন মনে করা হয়? আমার জানামতে নেই। এখন হিন্দু, ইসলাম, খ্রিষ্ট—সব ধর্মেই কেউ মারা গেলে একটা গাড়ি ভাড়া করে তাতে মরদেহ তুলে দেওয়া হয়। আগে কিন্তু তেমন ছিল না। মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় কলেমা পড়া থামানো উচিত নয়। মানুষের পেছন পেছন যাই। কেউ কলেমা থামালে তাকে ধমকাই। সমাজের কতটুকু উপকার হয় জানি না, তবে আমার মনে হয়, মৃত ব্যক্তির জন্য কিছু করলাম। এ কাজের জন্য আমাকে ২০০৩ সালে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ থেকে শ্মশানবন্ধু সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো স্বীকৃতি পাইনি, চাইনি।’

কানুদাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। নিজে না বললে কথা শোনা আরও কঠিন। অকৃতদার মানুষটি থাকেন একচালা এক টিনের ঘরে। সে ঘরের সামনে এক শিশু নিমগাছ দাঁড়িয়ে দরজা পাহারা দেয়। দুদিন ধরে খুঁজে খুঁজে অবশেষে চৌরঙ্গীর মোড়ে দেখা পাওয়া গেল তাঁর।
প্রথম রাতের গল্প ছিল তাঁর কিশোর বয়সকাল পর্যন্ত। পরদিন দুপুরে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হলো শ্মশানে। সেখানকার বর্ষীয়ান ছাতিমগাছটার তলায় বসে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। এক পাশে বয়ে যাচ্ছে কুমার নদ। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ। একটু একটু করে জানালেন, তাঁর পরবর্তী জীবনের গল্প। বললেন, ‘শুনলে বিশ্বাস করবেন কি না, একজীবনে প্রায় ৭৭ বছর শুধু দাহর কাজ করেছি। কত হাজার মানুষের শেষকৃত্য করলাম, শুধু নিজের বাবার খবরটাই পেলাম না। মৃতের স্বজনের কাছ থেকে পয়সা নিইনি। কতবার দায়ে ঠেকে আপনজনেরা এসেছে। হয়তো ঝড়–বৃষ্টি হচ্ছে, কেউ রাজি হচ্ছে না। হত্যা বা আত্মহত্যার মরদেহ পড়ে আছে কয়েক দিন ধরে লাশকাটা ঘরে। সেলাইগুলো হাঁ হয়ে আছে। সেই দেহ পাটিতে মুড়ে, বাঁশে বেঁধে নিয়ে রওনা হয়েছি। কোন ধর্মের মাথা ঘামাইনি। ফিরিয়ে দিইনি পারতপক্ষে কাউকে। এখন আর কাঁধে তুলতে পারি না তাই শ্মশানে আসি না। তিন বছর পর এলাম। পুরোনো মানুষের কথায় এখন আর আগ্রহ নেই মানুষের। আপনাদের প্রজন্মের জানা দরকার, যা কিছু শেখার তা অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই শিখতে হয়!’

অনেক বয়স হয়েছে সে কথা কানুদা মানেন না নিজের জন্য। তবে অভিজ্ঞতার হিসেবে তাঁর জীবনটাই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ গৌরবটুকু তিনি উদযাপন করেন। তখন বলেন, জীবন দীর্ঘ হলে কত ঘটনাই না দেখা হয় !