চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের এক কোনায় কালো চশমা চোখে বিষণ্ন মুখে শুয়ে আছেন নুর মোহাম্মদ। সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণকবলিত বিএম কনটেইনার ডিপোটির সিডি সুপারভাইজার তিনি। তাঁর মুখে কালো কালো দাগ হয়ে গেছে। ঠোঁট জোড়া ফোলা। চোখের কী অবস্থা?—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবকিছু ঝাপসা দেখতেছি। মনে হইতেছে চোখের ওপর কেউ একটা কাপড় বাঁধি দিছে।’
চিকিৎসক কী বলেছেন জানতে চাইল ১৯ বছরের নুর মোহাম্মদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ডাক্তারে ধৈর্য ধরতে কইছে। চোখের চিন্তায় আমি অস্থির না। আমি তো ঝাপসা হলেও দেখছি। আমার কত পরিচিত, বন্ধু তো কোনো দিন আর এই পৃথিবীটাই দেখবে না। তাদের শুধু তো চোখ না, প্রাণটাই কাড়ি নিল আগুন।’
চোখের আঘাত নিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন সহকারী প্রকল্প প্রকৌশলী আরিফ আল মামুন। বয়স ২৮ বছর। কর্মজীবনের সবে শুরু। জীবনের শুরুতে এত বড় আঘাত তাঁকে একধরনের ট্রমার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। চোখের আঘাতটা বড় কোনো ক্ষতি করেছে কিনা তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত।
সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণ কেড়ে নিল ৪১ জনের প্রাণ। বেঁচে যাওয়া বহু মানুষের চোখ, হাত ও পায়ের ক্ষতি হয়েছে। সদ্য চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন মমিনুল। আগুন জ্বলতে থাকলে বাবাকে ফোন করে বলেছিলেন, বিস্ফোরণে তাঁর পা উড়ে গেছে। এর কিছুক্ষণ পর উড়ে যায় তাঁর প্রাণপাখিটা।
দুই পায়ে ক্ষত নিয়ে ৬ নম্বর শয্যায় ব্যথায় কাতরাচ্ছেন নোয়াখালীর মো. ফারুক। তিনি ডিপোর কর্মী। বললেন, ‘ভাইরে, হাত–পা–চোখ হারাইয়া বাঁইচা থাইকা লাভ কী? আল্লাহর কাছে শোকর। আমারে আর আমার পা দুইটারে মনে হয় রক্ষা করছে।’ বলেই কাঁদতে শুরু করেন তিনি।
গতকাল সোমবার দুপুর ১২টায় হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে আহত মানুষের মধ্যে নিজেদের কষ্টের চেয়ে হারিয়ে যাওয়া সহকর্মীদের জন্য সহমর্মিতা লক্ষ করা গেছে। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিস্ফোরণে আহত ১০২ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁদের জীবনহানির আশঙ্কা নেই। তবে মৃত্যুর যে বিভীষিকা তাঁরা দেখেছেন, যে হাহাকার তাঁরা শুনেছেন, সেই দুঃসহ স্মৃতি তাঁদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
বার্ন ইউনিটের ৮ নম্বর শয্যায় হাতের আঘাত নিয়ে শুয়ে আছেন ৪০ বছর বয়সী সিরাজ। তাঁর চোখে মুখে আতঙ্ক। তাঁর শারীরিক তেমন ক্ষতি হয়নি, এটা জানানোর পরও তিনি আশ্বস্ত হতে পারছেন না। সিরাজের মতো বিধান চন্দ্র দেও একই রকম মানসিক অবস্থায় আছেন। তিনি পায়ে আঘাত পেয়েছেন। পা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। বিধানের বাড়ি নোয়াখালী।
কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে মানুষ প্রথমে প্রাণটা বাঁচাতে চায়। এরপর তাঁরা হাত, পা, চোখ বাঁচাতে চায়। কেননা এসব অঙ্গহীনতা মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। ঠিক এই মুহূর্তে ৫ জুন রোববার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে।
তখন দুপুর ১২টা। চারদিকে মানুষের আহাজারি, রক্তের জন্য দৌড়াদৌড়ি, মনে হলো মানুষ যেন একেবারে শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীটা যেন একটু পরেই শেষ হয়ে যাবে। ঠিক সেই সময় জরুরি বিভাগের একটি কক্ষে একটি মানুষ নির্বাক শুয়ে আছেন। তাঁর শরীর সাদা কাফনে ঢাকা।
পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছেন। পরিচয় চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আশ্চর্য একটা ব্যাপার, কাফনের কাপড়ের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে গেছে তাঁর একটি হাত। পোড়া কালো হাতটির এমন ভঙ্গি যেন সেটি পৃথিবীর সব মানুষকে হাত নেড়ে বিদায় বলছে। বহু মানুষের মগজে এই স্মৃতি একটি স্থায়ী ভাস্কর্য হয়ে স্থির হয়ে থাকবে।