কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী হাঙর ভাস্কর্য মোড় থেকে পূর্ব দিকে পাঁচ কিলোমিটার গেলে কক্সবাজার সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস। তার উল্টো দিকে ইলিয়াছ মিয়া চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির পাশ ঘেঁষে উত্তর দিকে চান্দের পাড়ায় চলে গেছে চার লেনের একটি কাঁচা রাস্তা। চান্দের পাড়া গ্রামটি পড়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নে। সড়কের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণমুখী ছয়তলা একটি ভবন।
ভবনটির মূল কাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ। এখন ভবনের চারদিকে গ্লাস লাগানো ও ছাদের ওপর স্টিলের ক্যানোফি বসানোর প্রস্তুতি চলছে। ভবনের ভেতরে চলছে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপন, ফায়ার ফাইটিং, স্যানেটারি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিসহ নানা কাজ। মূল রেলস্টেশন ভবনের পূর্ব পাশে চলছে পদচারী–সেতু ও প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ।
সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন এটি। ২৯ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা রেলস্টেশন ভবনটি ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুটের। ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি কক্সবাজারে আসবে স্বপ্নের রেল।
রেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বপ্নপূরণের পথে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের কাজ। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৬৯ শতাংশ। ইতিমধ্যে কক্সবাজারের রামু, ঈদগাঁও, পেকুয়া ও চকরিয়া অংশে প্রায় ২৮ কিলোমিটার রেলট্রেক বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। দিন–রাত কাজ করছেন ১৫০ জন প্রকৌশলীসহ প্রায় ২ হাজার শ্রমিক। এ ছাড়া আইকনিক রেলস্টেশন ভবন, ছোট-বড় সেতু, কালভার্ট, লেভেল ক্রসিং ও হাইওয়ে ক্রসিংয়ের কাজও পুরোদমে চলছে।
চান্দের পাড়া গ্রামটি ছিল ধান চাষের জায়গা। এই জায়গা ভরাট করে চলছে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনসহ নানা অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ। ৩ এপ্রিল সরেজমিনে দেখা গেছে, চান্দের পাড়ার মধ্যভাগে ২৯ একর জায়গাজুড়ে চলছে রেলস্টেশন নির্মাণযজ্ঞ।
ছয় শতাধিক শ্রমিক ও প্রকৌশলী স্টেশন ভবন, পদচারী–সেতু, প্ল্যাটফর্ম ও ১৯টির বেশি বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। ছয়তলা ভবনের কোথায় কী হচ্ছে, তার সবকিছু এই প্রতিবেদকের কাছে বর্ণনা দিলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার শিশির মণ্ডল। তিনি বললেন, ছয়তলা রেলস্টেশনের মূল ভবনটির কাজ শেষ। এখন ভবনের চারদিকের গ্লাস ফিটিংস, ছাদের ওপর স্টিলের ক্যানোফি টানার প্রস্তুতি চলছে। এগুলো চীন থেকে আমদানি হবে। পাশাপাশি ভবনের দরজা–জানালা ফিটিংস, টাইলস, স্যানিটারি, বিদ্যুতের লাইন ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপনের কাজ চলছে।
মূল ভবনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি হবে ঝিনুকাকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। তারপর চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে পদচারী–সেতু হয়ে উঠবেন ট্রেনে। আবার ট্রেন থেকে নেমে ভিন্ন পথে বেরিয়ে যাত্রীরা পা বাড়াবেন সৈকতশহরে। এ জন্য তৈরি হচ্ছে গমন ও বহির্গমনের পৃথক দুটি সড়ক। থাকছে গাড়ি পার্কিংয়ের তিনটি বড় জায়গা।
ভবনের পূর্ব পাশে নির্মিত হচ্ছে ৮০ ফুট লম্বা পদচারী–সেতু। এর সঙ্গে যুক্ত হবে পৃথক তিনটি চলন্ত সিঁড়ি। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ভবনের উত্তরে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য ৬৫০ মিটার ও প্রস্থ ১২ মিটার।
ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজারে নেমে পর্যটকেরা লাগেজ স্টেশনে রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন নিজ গন্তব্যে।মো. আবদুল জব্বার, কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্প
মূল ভবনের নিচতলায় থাকবে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনাকক্ষ, লকার, তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা,
পেসেঞ্জার লাউঞ্জ ও পদচারী–সেতুতে যাতায়াতের পথ। দ্বিতীয় তলায় থাকবে শপিং মল, শিশুযত্নকেন্দ্র, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। তৃতীয় তলায় ৩৯ কক্ষবিশিষ্ট তারকামানের হোটেল; চতুর্থ তলায় রেস্তোরাঁ, শিশুযত্নকেন্দ্র, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয়।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের (আইকনিক স্টেশন বিল্ডিং) কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মো. আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ কিলোমিটারের নির্মাণাধীন রেলপথের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে আইকনিক এই রেলস্টেশন। যেখানে থাকছে তারকামানের হোটেল, শপিং মল, রেস্তোরাঁ, শিশুযত্নকেন্দ্র, লকার বা লাগেজ রাখার স্থান। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজারে নেমে পর্যটকেরা লাগেজ, মালামাল স্টেশনে রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন নিজ গন্তব্যে।
রেলওয়ে প্রজেক্টের (আইকনিক স্টেশন বিল্ডিং) প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. ফরহাদ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ছয়তলা আইকনিক স্টেশন ভবনের মূল কাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। প্ল্যাটফর্ম ও পদচারী–সেতুর কাজও ৩০ শতাংশ এগিয়েছে। ছাদের কাঠামো স্থাপনসহ ভবনের অন্যান্য কাজ চলতি এপ্রিল মাসে শুরু হবে। বর্ষা মৌসুমেও কাজে সমস্যা হবে না। কারণ, ভবনের মূল কাঠামোর কাজ যেহেতু শেষ, ফলে এই কাজগুলো ভেতরে বসে করা যাবে। মেয়াদের দুই মাস আগেই যেন আইকনিক রেলস্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হয়, সে লক্ষ্যে পুরোদমে কাজ চালানো হচ্ছে। স্টেশন ভবনের পশ্চিম পাশে একসঙ্গে চলছে পাঁচতলা ২০টি ভবনের নির্মাণকাজ।