অল্প সময়ের মধ্যে মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার বিচার হয়েছে, এটা আমাদের জন্য স্বস্তির ব্যাপার। তবে একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিটা আমরা স্বস্তির সঙ্গে দেখি না। আমরা মনে করি, প্রাণ হরণ করার অধিকার কারোরই, এমনকি রাষ্ট্রেরও থাকা উচিত নয়।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে সবার কাছেই একটা বার্তা গেল যে অন্যায় করে পার পাওয়া যায় না এবং কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু এই ঘটনায় এটাও দেখতে হবে, প্রত্যেকের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, এখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আর যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা পুলিশের কর্মকর্তা ও অন্যান্য ব্যক্তি। এখানে ক্ষমতার একটা স্তর নিশ্চয়ই রয়েছে। আমরা ভেবেও নিতে পারি, এই হত্যাকাণ্ড এত আলোচিত হয়েছে, এতে জনমত তৈরি হয়েছে।
ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, যাঁর বিরুদ্ধে এত বেশি মানুষের অভিযোগ এসেছে যে এই ঘটনা কোনোভাবেই অন্যদিকে মোড় নিতে পারেনি। বিচার সম্পন্ন হয়েছে এবং আদালতের দ্বারা শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরেই এই কাজগুলো করে আসছিলেন। এর আগে ওসি প্রদীপের হাতে যাঁদের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে বা অত্যাচারিত হতে হয়েছে, তাঁদের কী হবে? তাঁরা তো অভিযোগটুকু করারও সাহস পাননি।
এখান থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায়, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাঁরা বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন, তাঁদের দিয়ে যদি নিয়মবহির্ভূতভাবে কোনো কাজ করানো হয়, একসময় তাঁরা ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে’ পরিণত হন। এর দৃষ্টান্ত আমরা এই ওসি প্রদীপের মধ্যে দেখতে পাই।
নাগরিকদের মধ্যে আমরা যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছি, তারা দেশের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলা একটা অনাচারের (বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে আসছি। দীর্ঘদিন ধরেই সরকারগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আসছি যে যাঁদের হাতে মারণাস্ত্র আছে, তাঁরা কিন্তু এসব অস্ত্র বিচারবহির্ভূত হত্যার কাজেও ব্যবহার করছেন। কিন্তু সেটা স্বীকার করা বা আমাদের কথা আমলে নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আমাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। বলা হয়েছে, এসব বলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছি। এখন তারা (সরকার) আজ আন্তর্জাতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন।
এটা সত্য কি মিথ্যা, সেটা পরের ব্যাপার। এখানে কোনো ভূরাজনৈতিক বিষয় আছে কি না, সেটাও পরের কথা। কিন্তু আজ তো তাদের একটা জবাবদিহির জায়গায় দাঁড়াতে হলো। এটা কিন্তু নাগরিকদের কাছেই করতে পারত। এখন সেটা বাইরের মানুষের কাছে করতে হচ্ছে। আমাদের অভিযোগ আমলে নিলে এই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। এটা তো শুধু তাদের (সরকারের) জন্য লজ্জার বিষয় নয়, নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্যও লজ্জার। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক একটা অভিজ্ঞতা।
এ ধরনের একটা ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে যেতেই পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখছি, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এমনকি এই বিষয় নিয়ে আমাদের আদালতে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। আদালত এই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার নির্দেশও দিয়েছিলেন।
র্যাব গঠনে আমাদের আপত্তি নেই, পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র থাকবে, সেটাও গণতান্ত্রিক সমাজে আমাদেরই সম্মতিতে হচ্ছে। আমাদের পরামর্শ ছিল, সম্পূর্ণ জবাবদিহি থাকতে হবে। কোন অবস্থায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে যদি দেখা যায় কেউ অন্যায়ভাবে বা নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যবহার করেছেন, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু এটা তো তারা করেইনি, বরং তাঁদের নানাভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। নীতিগতভাবে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সরকারগুলো যদি এই বিষয়ে অনেক আগে থেকে নজর দিত, অভিযোগগুলো স্বীকার করে নিয়ে সেগুলো সুরাহা করার কার্যকর ব্যবস্থা নিত, তাহলে আজ এই পর্যায়ে পৌঁছাতে হতো না। তারপরও আশা করব, সিনহা হত্যার রায়ের পর সরকার বিষয়টাকে (বিচারবহির্ভূত হত্যা) আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। আশা করব, ভবিষ্যতে আমাদেরই নিয়োজিত বাহিনীর দ্বারা আমাদেরই নাগরিকেরা এই ধরনের বিচারবহির্ভূত আচরণের শিকার হবেন না।
#● সুলতানা কামাল, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী