বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা ১৪ মাস আগে বলেছিলেন, মশার ওষুধ কার্যকারিতা হারিয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ছিটানো ওষুধে মশা মরছে না। সব জেনেও কর্তৃপক্ষ মশা মারার ওষুধ পরিবর্তনে পদক্ষেপ নেয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ওষুধ অকার্যকর হওয়ার কথা সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিকল্প ওষুধের সুপারিশ করেনি। তাই আগের ওষুধই ব্যবহার করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ যদি এখনই ওষুধ পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে নতুন ওষুধ ব্যবহার করতে অন্তত ছয় মাস লাগবে।
এদিকে রাজধানীর মানুষ মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা শহরে বহু বছর ধরে মশা মারতে একই ওষুধ বা কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ ব্যবহারে অকার্যকর হয়ে পড়েছে ওষুধ। মশা ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। মশা মারতে হলে নতুন ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। কীটনাশকের বাইরে অন্য বিকল্প পন্থাও বেছে নিতে হবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, এত দিনেও ওষুধ পরিবর্তন করার পদক্ষেপ না নেওয়ার অর্থ সরকার বৈজ্ঞানিক তথ্য অস্বীকার করছে, না হয় জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্বহীন মনে করছে। জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের এ ধরনের অবহেলা ও উদ্যোগহীনতা ক্ষমার অযোগ্য।
সিটি করপোরেশন এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিবছরই মশার ওষুধ ছিটান। কর্মকর্তারা বলেছেন, দুই ধরনের ওষুধ তাঁরা ব্যবহার করেন। পূর্ণাঙ্গ মশা ও মশার লার্ভা মারার জন্য যথাক্রমে এডাল্টি সাইট ও লার্ভা সাইট ব্যবহার করা হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে তাঁরা ১৯ কোটি টাকার ওষুধ কিনেছিলেন। উত্তর সিটি করপোরেশন কিনেছে ১৮ কোটি টাকার ওষুধ।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু ওষুধে মশা মরছে না এ বিষয়টি আমাদের জানা আছে। ওষুধ পরিবর্তন করা হবে, নতুন ওষুধ কেনা হবে। এ ব্যাপারে আইসডিডিআরবি, আইইডিসিআর ও পরিবেশবিদদের নিয়ে আগামী সপ্তাহে একটি সভা ডাকা হয়েছে।’
গবেষণার তথ্য
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ডেঙ্গু ভাইরাস বাহক এডিস মশা প্রচলিত কীটনাশক দিয়ে মরছে না। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের মার্চের মধ্যে করা গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, ঢাকা শহরের এডিস মশা ওষুধপ্রতিরোধী। বর্তমান ওষুধে তারা মরে না।
>বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডেঙ্গু ভাইরাস বাহক এডিস মশা প্রচলিত কীটনাশক দিয়ে মরছে না।
এডিস মশা ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া ও জিকার সংক্রমণ ঘটায়
আইসিডিডিআরবির প্যারাসাইটোলজি ল্যাবরেটরির সহযোগী বিজ্ঞানী ও এই গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ শফিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আজিমপুর, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, গুলশান, কড়াইল, মিরপুর ১, উত্তরা সেক্টর ৪, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া ও খিলগাঁও এলাকা থেকে এডিস মশার ডিম সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষাগারে সেই ডিম থেকে লার্ভা ও পরে মশা তৈরি করা হয়। সেই মশাকে ঢাকা শহরে ব্যবহার করা হচ্ছে, এমন কীটনাশকের সংস্পর্শে আনা হয়। তাতে দেখা যায়, সব মশা মরছে না। কীটনাশকের বিষক্রিয়া সহ্য করেও অনেক মশা বেঁচে থাকছে। তিনি বলেন, ‘ল্যাবরেটরির এই ফলাফলের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির মিল আছে বলেই আমরা মনে করি।’ এই গবেষণা হয়েছিল শুধু মশার ওষুধ নিয়ে। লার্ভার ওষুধের কার্যকারিতা অবশ্য দেখা হয়নি।
এই গবেষণার সঙ্গে আইসিডিডিআরবির তিনজন ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিষ্ঠানের তিনজন বিজ্ঞানী যুক্ত ছিলেন। গত বছর ২২ মে এই গবেষণা ফলাফল একটি অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে প্রকাশ করে আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (সিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক সোনিয়া তাহমিনা এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক মিরজাদী সাব্রিনা ফ্লোরা উপস্থিত ছিলেন। দুই সিটির তখনকার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাও ছিলেন।
সরকারি কর্মকর্তারা গবেষণা ফলাফল নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। ওষুধ পরিবর্তন করার ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ নেননি। তাঁরা ঢাকা শহরে কিউলেক্স মশার ওপর কীটনাশকের প্রভাব যাচাই করার উদ্যোগ নেন। সিডিসি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে রাজধানীর সাতটি এলাকার কিউলেক্স মশা নিয়ে গবেষণা করে। এতে কারিগরি সহায়তা দেয় আইসিডিডিআরবি। ওই গবেষণাতেও ওষুধের অকার্যকারিতা ধরা পড়ে।
এই ওষুধ কত বছর আগে থেকে অকার্যকর হয়েছে, তা অবশ্য গবেষণা থেকে জানা যায়নি। তবে মঞ্জুর চৌধুরী দাবি করেছেন, নিজের উদ্যোগে করা ছোট গবেষণায় তিনি দেখেছেন, ১৫ বছর আগে থেকে এটা হয়ে আসছে। সিটি করপোরেশন নিজ উদ্যোগে কাজটি করলে আগেই তারা জানতে পারত।
কে কী করেছে
অকার্যকর জেনেও দুই সিটি করপোরেশন এ বছর পুরোনো ওষুধই ব্যবহার করেছে। সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা বলেছেন, শুরু থেকেই দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গবেষণার বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল এবং গবেষণা ফলাফল সম্পর্কেও দুই সিটি করপোরেশন জানে।
এ বছর এপ্রিলে দুটি গবেষণা ফলাফল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সভা কক্ষে উপস্থাপন করা হয়। আইসিডিডিআরবি, সিডিসির বিজ্ঞানী ও গবেষক ছাড়াও সভায় অন্যান্যের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এরপর গত ১৮ জুন আইসিডিডিআরবি ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের একটি প্রতিনিধিদল আতিকুল ইসলাম ও তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে সভা করে।
সিডিসির পরিচালক অধ্যাপক সোনিয়া তাহমিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে আমরা উত্তরের মেয়রকে জানিয়েছি।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোন ওষুধ অকার্যকর, সে কথা জানিয়েছেন গবেষকেরা। কিন্তু নতুন কোন ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, তার নাম কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে জানাননি, সিদ্ধান্ত কেউ দেননি।’ তিনি আরও বলেন, মশা নিধনে কার্যকর এমন অনেক ওষুধ আছে। কিন্তু এমন ওষুধের নিবন্ধন বা অনুমোদন নেই। নতুন ওষুধের অনুমোদন নেওয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
যেকোনো কীটনাশকের অনুমোদন দেয় সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি কারিগরি কমিটি। অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (বালাইনাশক ও মান নিয়ন্ত্রণ) মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন পণ্যের অনুমোদন চেয়ে প্রথমে আবেদন করতে হয়। এরপর সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি মেনে কারিগরি কমিটি কীটনাশকের অনুমোদন দেয়। সব ঠিক থাকলে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগে।
অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, আর দেরি না করে নতুন ওষুধ কেনার ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিক, এটাই নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা।