নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানার ছয়তলা যে ভবনটি আগুনে পুড়ে গেছে, সেখানে প্রায় আড়াই শ শ্রমিক কাজ করতেন। তাঁদের কেউই গত জুন মাসের বেতন পাননি। বেতন পাওয়ার আগেই গত বৃহস্পতিবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন ৫২ জন শ্রমিক। এমন পরিস্থিতিতে কবে জুন মাসের বেতন হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বেঁচে যাওয়া শ্রমিকেরা।
কারখানার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ ২০ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বেশির ভাগ শ্রমিকের বেতন পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকার মধ্যে। বাড়তি টাকার জন্য প্রায় সবাই নির্ধারিত সময়ের বাইরে অতিরিক্ত কাজ (ওভারটাইম) করতেন। চার মাসের ওভারটাইমের টাকা না দেওয়ায় আগুন লাগার এক সপ্তাহ আগে (১ জুলাই) শ্রমিকেরা বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছিলেন। বিক্ষোভের পরদিন দুই মাসের ওভারটাইমের টাকা পরিশোধ করে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
ওভারটাইমের টাকা নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কথা অস্বীকার করেননি কারখানার কর্মকর্তারা। হাসেম ফুডসের সহকারী ব্যবস্থাপক (হিসাব) নাহিদ মুরাদ বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে ওভারটাইমের টাকা সম্প্রতি পরিশোধ করা হয়েছে।
হাসেম ফুডসের ছোট–বড় সাতটি কারখানা ভবনে আড়াই হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এসব কারখানায় জুস, চকলেট, বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাই, ঝালমুড়িসহ নানা প্রকারের খাদ্যপণ্য তৈরি হয়। গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর কারখানার পূর্ব দিকের ছয়তলা ভবনে (স্টোর ভবন হিসেবে পরিচিত) ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রায় ১৯ ঘণ্টার চেষ্টায় শুক্রবার দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। বৃহস্পতিবার আগুন লাগার ঘণ্টাখানেক পর ভবনের চতুর্থ তলার জানালা ভেঙে উদ্ধার করা হয় দিনাজপুরের যুবক আবদুর রবকে। উদ্ধারের পরপরই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। দুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর শনিবার রাতে দিনাজপুরে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন। এখনো দম নিতে কষ্ট হয় তাঁর। গতকাল দুপুরে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর চিকিৎসার খোঁজ কারখানা কর্তৃপক্ষের কেউ নেয়নি। এ পরিস্থিতিতে বেতন–বোনাস আদৌ পাবেন কি না, তিনি জানেন না।
বেতন–বোনাসের পাশাপাশি শ্রমিকদের মধ্যে চাকরি নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এই কারখানা খুলতে বহু সময় লেগে যেতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। এমন পরিস্থিতিতে রুটি–রুজির প্রশ্ন তাঁদের সামনে বড় হয়ে উঠেছে। কারখানার সহকারী প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল) মুক্তার হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই মাসের ১১ তারিখ হয়ে গেল, আমরা বেতন পাইনি। এর মধ্যে মালিক জেলে। সামনে ঈদ। কবে কারখানা চালু হবে, সেটিও জানি না।’
বেতন ও বোনাস নিয়ে শ্রমিকদের উদ্বেগের বিষয়ে হাসেম ফুডসের সহকারী ব্যবস্থাপক (হিসাব) নাহিদ মুরাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এদিকে গতকালও কারখানার প্রবেশপথের প্রধান ফটকের সামনে নিখোঁজ শ্রমিকদের ছবি হাতে জড়ো হন স্বজনেরা। তাঁরা এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। সেখানে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এখানে শিশু শ্রমিকেরা কাজ করত। কীভাবে কাদের মাধ্যমে শিশুদের কাজের জন্য এখানে নিয়ে আসা হলো তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন নিয়ে এসব কারখানা গড়ে তোলা হয়, সে ক্ষেত্রে কারও কোনো অনিয়ম আছে কি না, সেগুলোও তদন্ত করা হচ্ছে।
পুড়ে যাওয়া কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, নিয়মনীতির মধ্যে না এলে এ ধরনের ঘটনা থামবে না। তিনি এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলেও উল্লেখ করেন। তাঁর সঙ্গে তখন ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, মুক্তিযোদ্ধা নঈম জাহাঙ্গীর, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইসতিয়াক আজিজ উলফাত, রাষ্ট্রচিন্তার হাসনাত কাইয়ুম, ভাসানী অনুসারী পরিষদের মো. ফরিদ উদ্দিন।
অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদি না থাকা এবং শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি নজরে আসার পর সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান কারখানা কর্তৃপক্ষকে কয়েক মাস আগে নোটিশ দিয়েছিল। সাত মাস আগে কারখানা পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। এ ছাড়া আইন অমান্য করে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ায় হাসেম ফুডসকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক (অপারেশন) সালাউদ্দিন আহমেদ ও নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপসহকারী পরিচালক তানহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থায় ত্রুটি থাকায় নোটিশ দেওয়া হলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি।
কলকারখানা পরিদর্শন ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গত ৭ জুন কারখানায় যায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি না, মূলত সেটি দেখতে গিয়ে শিশু শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করানোর বিষয়টি জানতে পারেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক নেছার আহমেদ বলেন, শিশুশ্রম বন্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়ার পরও কারখানা কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি। কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবও দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষের নানা অবহেলার পাশাপাশি এসব অনিয়ম যাদের দেখার কথা, তারা যদি সঠিক পদক্ষেপ নিত, তাহলে এত মানুষের মৃত্যু হতো না।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে সরকারি তিনটি সংস্থা ফায়ার সার্ভিস, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করেছে। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকাল সকাল ১০টায় কারখানায় আসেন এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে কারখানার প্রশাসনিক ভবনে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ১২ জনের জবানবন্দি নেন। তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব ও ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক নূর হাসান আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগুন লাগার সম্ভাব্য সব বিষয় মাথায় নিয়ে তদন্তকাজ শুরু করেছেন তাঁরা। এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি কীভাবে সেদিন আগুন লেগেছিল।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কারখানার নিরাপত্তারক্ষী মো. ফাহাদ প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন আগুন লেগেছিল ঠিক ৫টা ৪৩ মিনিটে। ফয়েল পেপারে যখন আগুন লাগে, তখন তা মুহূর্তের মধ্যে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
আগুনে পুড়ে যাওয়া কারখানাটি সজীব গ্রুপ অব কোম্পানিজের মালিকানাধীন। তাদের তৈরি সেজান জুসসহ নানা ধরনের খাদ্যপণ্য বাজারে রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পর শনিবার সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম ও তাঁর চার ছেলেসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে করা হত্যা মামলায় ৫১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ উল্লেখ করলেও আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং উদ্ধার তৎরতায় অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা শুরু থেকেই ৫২ জন নিহত হওয়ার কথা বলছেন।
এদিকে আবুল হাসেমসহ গ্রেপ্তার আট আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে রূপগঞ্জ থানা-পুলিশ। কেন কারখানাটিতে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ছিল না, শিশু শ্রমিকদের কী কারণে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এসব বিষয় নিয়ে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আসামিরা এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।