খেজুরের গুড়ের পিঠা-পুলি-পায়েস দেশের শত শত বছরের ঐতিহ্য। এখন রীতিমতো গাছ ইজারা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হয় গুড়। অনলাইন বাণিজ্যও জমজমাট।
শরীরে প্যাঁচানো দড়ি। কোমরে বাঁশের ঝুড়ি, ভেতরে বাটাল-হাঁসুয়া। একপাশে ঝুলছে মাটির হাঁড়ি। তরতর করে বেয়ে গাছি উঠছেন খেজুরগাছে। গাছের ছাল-বাকল তুলে গাছি হাঁড়ি বেঁধে দিচ্ছেন। শীতকালে এটি গ্রামবাংলার পরিচিত দৃশ্য।
শীতের সকালে এই খেজুরের রসের স্বাদ নিতে চায় বাঙালি। আর খেজুরের তরল গুড় বা পাটালি দিয়ে পিঠা-পুলি-পায়েস খাওয়া এ দেশের ঐতিহ্য।
দেশে একসময় গ্রামে গ্রামে গাছিরা খেজুরগাছ থেকে রস নামানো ও গুড় তৈরির কাজটি করতেন। রসের একটি অংশ গাছি নিতেন, একটি অংশ পেতেন গাছের মালিক। কিছু কিছু বিক্রিও হতো। এই সনাতন ব্যবস্থা থেকে খেজুর গুড় উৎপাদন এখন বাণিজ্যিক রূপ পাচ্ছে। মৌসুম এলে খেজুরগাছ রীতিমতো ইজারা দেওয়া হয়। কোনো কোনো এলাকায় এখন খেজুরগাছ লাগানো হয় বাণিজ্যিকভাবে। রস নামানো ও গুড় তৈরি কোথাও কোথাও মজুরিভিত্তিক পেশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আবার সনাতন বাজার ব্যবস্থার বাইরে খেজুরের গুড়ের অনলাইন বাণিজ্যও হচ্ছে।
ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস বইতে পাওয়া যায়, ১৯০০-০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মণ, যা প্রায় ৮২ হাজার টনের সমান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ১ লাখ ৭০ হাজার টন খেজুরের রস উৎপাদিত হয়। গাছিরা বলছেন, ১০ কেজি রস দিয়ে তৈরি হয় প্রায় এক কেজি পাটালি। এ হিসাবে দেশে পাটালি উৎপাদিত হয় ১৭ হাজার টন। গড়ে ২০০ টাকা কেজি হিসেবে খেজুর গুড়ের বাজারের আকার ৩৪০ কোটি টাকা।
বিবিএস বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে পাঁচ হাজার একরের কিছু বেশি জমিতে বাণিজ্যিক খেজুরবাগান ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ৬৩ হাজার একর ছাড়িয়েছে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাগানের বাইরে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ও বেড়ে ওঠা খেজুরগাছ কমছে।
খেজুরের গুড়ের মৌসুম শীতকাল, এটা সবার জানা। তবে গাছ কেটে কীভাবে গুড় হয়, তা হয়তো অনেকের অজানা। গাছিরা বলেন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে খেজুরের গাছ তোলা হয়। মানে হলো, গাছের মাথার দিকের এক পাশের ছাল-বাকল তুলে ফেলা হয়। এরপর কয়েক দিনে ছাল তোলা অংশটি শুকায়। অগ্রহায়ণের শেষে খেজুরগাছের ছাল তোলা অংশ চেঁছে ওপরের দিকে দুটি চোখ কাটা হয়। নিচের দিকে নলি (বাঁশের তৈরি নল) পোঁতা হয়। এই নলি দিয়েই ফোঁটায় ফোঁটায় রস গাছে ঝোলানো মাটির হাঁড়িতে জমা হয়।
প্রথম কাটের রস দিয়ে তৈরি করা হয় নলেন গুড়। যশোরের অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রামের গাছি সাহাদাত গাজী বলেন, নলেন গুড়ের স্বাদ সবচেয়ে বেশি। ঘ্রাণও বেশি থাকে এই গুড়ে। নলেন গুড় দিয়েই তৈরি হয় সুস্বাদু সন্দেশ, প্যাড়া-সন্দেশ, ক্ষীর-পায়েস। প্রথম কাটের পর পালা কাটা হয়। পালা কাটার রসে তৈরি গুড়ে স্বাদ-ঘ্রাণ কম থাকে। তিনি আরও বলেন, এ বছর খেজুরগাছ থেকে রস কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে রস, গুড় ও পাটালির দাম বেশ ভালো।
খেজুরের গুড়ের ক্ষেত্রে সবার আগে দেশের যে অঞ্চলের নাম আসে, তার মধ্যে রয়েছে যশোর ও কুষ্টিয়া। যশোর অঞ্চলের লোকপরম্পরাগত কথন—‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’।
যশোরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে জেলার আট উপজেলায় প্রায় আট লাখ খেজুরগাছ আছে। সবচেয়ে বেশি রয়েছে যশোর সদর, মনিরামপুর, শার্শা, চৌগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলায়। জেলায় বছরে গড়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার টন গুড়-পাটালি উৎপাদিত হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মাঠে জন্মানো খেজুরগাছগুলো কাটা পড়ছে। এখন পরিকল্পিতভাবে খেজুরগাছ লাগানোর জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে চারা উৎপাদন করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, জেলায় মানসম্মত গুড়-পাটালি উৎপাদন বেড়েছে। ভেজাল কমছে। এতে চাষিরা লাভবান হচ্ছেন।
এদিকে যশোর বন বিভাগ সূত্র জানায়, জেলার বন বিভাগের উদ্যোগে ২০০৯ সাল থেকে খেজুরগাছ রোপণ করা হচ্ছে। ‘বৃহত্তর যশোরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় জেলায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ খেজুরগাছের চারা রোপণ করা হয়েছে।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা গ্রামের গাছি হারুন মোল্যা (৬৬) প্রায় ৪৫ বছর ধরে গুড়-পাটালি উৎপাদন করেন। তিনি বলেন, এবার রস সংগ্রহের জন্য ১২৮টি খেজুরগাছ কাটার ইজারা নিয়েছেন। প্রতিদিন কাটেন ২৫টি করে গাছ। দিনে ১৫-১৬ হাঁড়ি রস পাওয়া যায়। কাঁচা রস তিনি প্রতি হাঁড়ি ১৫০ টাকায় বিক্রি করেন।
হারুন মোল্যা আরও বলেন, এক সপ্তাহ গাছ কাটলে যে রস পাওয়া যায়, তা দিয়ে এক মণের বেশি তরল গুড় অথবা শক্ত পাটালি তৈরি হয়। তরল গুড় প্রতি কেজি ২০০ টাকায় বিক্রি করেন। এবার মৌসুমের শুরুর দিকে শক্ত গুড় বা পাটালি ৩০০ টাকা করে কেজি বিক্রি করেছেন। এখন আড়াই শ টাকা দরে বিক্রি করছেন। ক্রেতারা বাড়ি থেকেই রস ও গুড় কিনে নেন।
শীত মৌসুমজুড়েই কুষ্টিয়ার মিরপুর, কুমারখালী ও সদর উপজেলার কয়েকটি জায়গায় খেজুরের রস নামানো, গুড় তৈরি ও কেনাবেচার ব্যবসা জমে। তবে শহরবাসীর গুড় কেনার পছন্দের জায়গা বাইপাস, কলাবাড়িয়া ও কুষ্টিয়া চিনিকল এলাকা, যা শহর থেকে মাত্র পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। সেখানে পথের দুই পাশে সারি সারি খেজুরগাছ। রস নামিয়ে মাঠেই গুড় তৈরি হয়। ক্রেতারা খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরির প্রক্রিয়া নিজ চোখে দেখে কিনতে পারেন।
সম্প্রতি ভোরে বাইপাস সড়ক ও কলাবাড়িয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রস ও গুড় কিনতে ভোরেই উপস্থিত ক্রেতারা। সেখানে গুড়ের কেজি মানভেদে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আর শুধু রসের হাঁড়ি ২০০ টাকা।
স্থানীয় শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা রাশিদুল ইসলাম কলাবাড়িয়া এলাকায় চিনিকলের খেজুরগাছগুলো প্রতিবছর ইজারা নেন। তিনি জানান, এবারও তিনি চিনিকলের কাছ থেকে ৫২ হাজার টাকায় প্রায় ৪০০ খেজুরগাছ ইজারা নিয়েছেন। এর বাইরে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৮০টি গাছ ইজারা নিতে তাঁর ব্যয় হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থেকে যাওয়া কয়েকজন গাছি মজুরি ভিত্তিতে সেখানে দিনরাত কাজ করেন।
গাছি আলম ঢালী বলেন, শীত মৌসুমে তাঁরা চার মাস খেজুরগাছ কাটা ও গুড় তৈরির কাজ করেন। থাকেন কুষ্টিয়া চিনিকলের পরিত্যক্ত একটি ভবনে। দিনে মজুরি ৫০০ টাকা। এক মৌসুমে একেকজনের আয় দাঁড়ায় ৬০ হাজার টাকা।
বাইপাস এলাকায় চারজন গাছির আরেকটি দল নাটোর থেকে যাওয়া। তাঁদের একজন শিহাব আলী ৪০০ গাছ ইজারা নিয়েছেন। তিনি বলেন, এক মৌসুমে ইজারা মূল্য বাবদ ৫২ হাজার টাকা, তিনজন কর্মীর মজুরি ও নিজের খরচ শেষে এক লাখ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন তিনি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গত বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা যায়, খেজুরের পাটালি গুড় ৭০ থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। আর তরল গুড় পাওয়া যায় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। তবে বিক্রেতারাই বলছেন, কম দামি যেসব গুড় রয়েছে, তা আসলে চিনিমিশ্রিত। এগুলোর বড় ক্রেতা ফুটপাতের পিঠা বিক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারের বাসার ট্রেডার্সের মালিক আবুল বাসার বলেন, বাজারে এখন খেজুর গুড়ের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। এ কারণে মৌসুমের শুরুর চেয়ে দাম কিছুটা কমেছে।
বাজারে যখন খাঁটি গুড় পাওয়া দুষ্কর, তখন অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। এসব বিক্রেতা খাঁটি গুড়ের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তবে দাম চাইছেন অনেক বেশি। একটি অনলাইনে ৫৫০ টাকা কেজিতেও গুড় বিক্রি করতে দেখা গেল।
যশোর থেকে অনলাইনে গুড় বিক্রি শুরু হয় মূলত ২০১৮ সাল থেকে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কেনার হাটের অন্যতম উদ্যোক্তা নাহিদুল ইসলাম বলেন, এ পর্যন্ত তাঁরা জেলার ৪টি উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৫০০ গাছিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে উপকরণ বিতরণ করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে ভেজালমুক্ত গুড় ও পাটালি কিনে তাঁর প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে। চলতি মৌসুমে ৩৫ হাজার কেজি গুড় ও পাটালি বিক্রির লক্ষ্য ঠিক করে তারা গত সপ্তাহ পর্যন্ত বিক্রি করেছেন আট হাজার কেজি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘খেজুরের গুড় যশোর’ নামের একটি পেজ রয়েছে। এটির মালিক যশোর মনিরামপুর থানাধীন
হেলাঞ্চি গ্রামের ছেলে সাদ্দাম হোসেন, যিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর তিনি নিজের সহকর্মীদের তাঁর চাচা আবুল গাজীর তৈরি খেজুরের গুড় এনে দিয়েছিলেন। সহকর্মীরা গুড়ের অনেক প্রশংসা করেন। তাঁদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পেয়েই তিনি পেজটি খুলেছেন। এ মৌসুমে ৪০০ কেজি গুড় সরবরাহ করেছেন তিনি।
শীতের পিঠা-পুলি, গুড়ের আসল-ভেজালের মধ্যে গাছিদের আক্ষেপ খেজুরগাছ কমে যাওয়া নিয়ে। তাঁরা বলছেন, শীত মৌসুমে ইটভাটার জ্বালানির জন্য খেজুরগাছ কেটে ফেলা হয়।
কুষ্টিয়ার গাছি শিহাব আলী বলেন, যে হারে খেজুরগাছ কমছে, তাতে একসময় হয়তো খেজুরগাছ হারিয়ে যাবে। তাই শুধু বাণিজ্যিক বাগান নয়, নারকেল ও সুপারিগাছের মতো সারা দেশে খেজুরগাছ লাগানো দরকার।