এমন বিয়োগান্ত ঘটনা যেন আর না হয়

ইতো নাওকি
ছবি: প্রথম আলো

গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত দেশি-বিদেশি ২২ জনের মধ্যে ৭ জন ছিলেন জাপানের নাগরিক। সে সময় জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকার জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইতো নাওকি। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ছয় বছর আগে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার সময় আপনি জাইকায় কর্মরত ছিলেন। বিয়োগান্ত ওই ঘটনার পরের পরিস্থিতিটা কেমন ছিল?

ইতো নাওকি: বিয়োগান্ত ওই ঘটনায় সাতজন জাপানি প্রকৌশলী নির্মমভাবে প্রাণ হারান। তাঁরা মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষার প্রস্তুতিমূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। ঢাকায় এমন একটি রোমহর্ষক জঙ্গি হামলা হতে পারে, তা আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। ওই সময় আমি টোকিওতে জাইকার জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলাম। নিহত সাত প্রকৌশলী বাংলাদেশে মানসম্পন্ন অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে নিজেদের জড়িত রেখেছিলেন। জঙ্গি হামলার পর দুই দেশের অংশীদারত্বের জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়। শোক কাটিয়ে মেট্রোরেলের কাজটা আবার শুরু করতে আমাদের প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল। আমরা জানতাম যে কাজটা আমাদের শুরু করতেই হবে।

প্রশ্ন

তার মানে দুই দেশের গভীর বন্ধুত্বের কারণে এ পরিস্থিতির উত্তরণ হয়েছিল...

ইতো নাওকি: অনেক বছর ধরেই জাপান-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও গুরুত্বর্পূণ অংশীদারত্ব গড়ে উঠেছে। তিন মাসের বিরতি থাকার পরও নির্ধারিত সময়ের আগেই কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে জটিল একটি পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও দুই দেশের বন্ধুত্বের অঙ্গীকার পূরণে কোনো ঘাটতি ছিল না।

প্রশ্ন

জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে জাইকার স্বেচ্ছাসেবীদের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এ কার্যক্রম কবে শুরু হবে?

ইতো নাওকি: ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশে জাইকার স্বেচ্ছাসেবীদের পাঠানো শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদানের পাশাপাশি দুই দেশের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রয়েছে এসব স্বেচ্ছাসেবীর। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে ২০১৫ সালে রংপুরে কোনিও হোশির মৃত্যুর পর বাংলাদেশে জাইকার স্বেচ্ছাসেবীদের পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর ঘটল হোলি আর্টিজানের হামলা। মনে রাখতে হবে, স্বেচ্ছাসেবী পাঠানোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছয় বছর আগের তুলনায় ঢাকাসহ বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। এখানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ–সম্পর্কিত ভ্রমণ সতর্কবার্তা পর্যালোচনা করে জাপান তা প্রথম স্তরে উন্নীত করেছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশে স্বাভাবিক নিয়মে ভ্রমণে কোনো বাধা নেই। আমার মনে হয়, স্বেচ্ছাসেবী পাঠানোর বিষয়টি পর্যালোচনা করার অবস্থায় রয়েছে জাইকা। এ বছর আমরা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্‌যাপন করছি। এই উদ্‌যাপনের বছরে আমরা যদি জাইকার স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ আবার শুরু করতে পারি, তবে তা হবে দারুণ একটি বিষয়।

প্রশ্ন

দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতা, শান্তিকামী মানসিকতার পরও কেন রংপুর ও ঢাকায় জাপানের নাগরিকেরা হামলার শিকার হলেন?

ইতো নাওকি: এ প্রশ্নের উত্তরটা বেশ দুরূহ। আমি নিজেও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াই। জানি এর সদুত্তর পাওয়াটা সহজ নয়। তবে একটা কথাই সব সময় বলব, এ ধরনের বিয়োগান্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোথাও আর না ঘটে। বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ দেশ। সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ নয়। সন্ত্রাসবাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্সের পাশাপাশি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করি।

প্রশ্ন

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো হয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, বিনিয়োগ এসব প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা সহযোগিতা কীভাবে বাড়ানোর কথা ভাবছেন?

ইতো নাওকি: আমরা বড় অবকাঠামো যেখানেই করি না কেন, নিরাপত্তায় আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার থাকে। সেটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, অন্য দেশেও প্রযোজ্য। গত ছয় বছরে জাইকার কোনো প্রকল্পে সন্ত্রাসের একটি ঘটনাও ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে চমৎকার সহযোগিতা রয়েছে। প্রতিবছর অন্তত একবার স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়, যেখানে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন। দুই দেশের বিদ্যমান নিরাপত্তা সহযোগিতা চমৎকারভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কেনাকাটায় চীন ও রাশিয়ার ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে বৈচিত্র্য আনতে চায়। আমরা এখানে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে তৈরি আছি।