যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। পাহাড়ি ঢল আর স্মরণকালের অতিবৃষ্টিতে ডুবে গেছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি; গ্রামের পর গ্রাম। পানির স্রোতে ভেসে গেছে কারও গোলাঘর, কারও গোয়ালঘর-বৈঠকখানা, কারও বসতঘর, কারও ভিটেমাটি। ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, ধর্ম-বর্ণ সবাই সমান কাতারে। যখন বৃষ্টি হচ্ছিল, হু হু করে বাড়ছিল বানের পানি; মানুষ চেয়েছিল আশ্রয়। প্রথমে কারও উঁচু বাড়িতে, মসজিদে, স্কুলঘরে; শেষ আশ্রয় বন্যা-আশ্রয়কেন্দ্রে।
মানুষ কি জানত তারা এতটা অসহায় হয়ে পড়বে? গতকাল দুপুরে যখন আমি গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের গ্রামগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি, তখন মনে হয়েছিল এক দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। গোয়াইনঘাটের শালুটিকরের পর থেকে রাস্তার দুই পাশের গ্রামগুলো শহরের কাছে বা উঁচু এলাকায় হলেও মিত্রিমহল, বহর, সিন্দ্রেরগাঁও, আঙ্গারজুর, মহিষখেড়, খাগাইল, রাজপুর, গৌরীনগর, বর্ণি, দলইরগাঁও গ্রামের প্রতিটি ঘর পানির নিচে তলিয়ে ছিল।
বর্ণি পেরোলেই চোখে পড়ে বিশাল সমুদ্রের; এর ভেতরে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে আছে ছগাম, পূর্ণাছগাম, ছামারারকান্দি, ফেদারগাঁও, তেলিখাল, ডিসকিবাড়ি, রংপুরিবস্তি, কামারগাঁও, বেতমুড়া, দিঘলবাকের পার, কাকুরাইল, গাছগড়, সালদিগা, মনুরপার, বতুমারা গ্রাম।
এসব গ্রামের মানুষ প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিল কাছের স্কুলঘরগুলোতে। সেসব আশ্রয়কেন্দ্র ডুবে গেলে পরে আশ্রয় নেয় দিঘলবাকেরপার-ফেদারগাঁও উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে।
গত শুক্রবার আমি যখন এখানে আসি, তখন আশ্রয়কেন্দ্র ছিল মানুষ ও পশুতে ভরা। তেমন কোনো খাবার ছিল না, পানীয়জল ছিল না। পানি কমতে থাকায় মানুষ কেন্দ্র থেকে সরতে শুরু করে বন্যার জলের মতোই। তারপরও এখানে অবস্থান করছে ১৮৭টি পরিবার।
ফেদারগাঁওয়ের ৬৫ বছরের নূর মিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী খেলেন এত দিন? আছেন কেমন? অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে জবাব দিলেন, ‘আমার দোকান ছিল; এখন কিচ্ছু নাই। ঘরের চালও গেছে। এখন আর খিদে লাগে না।’ গাছগড়ের ৭৩ বছরের আবদুল খালিক বলেন, ‘এমন পানি এই জনমে দেখিনি বাপ। বন্যা নিছে আমার সব। সাঁতরাইয়া আসছি। আমরা কিচ্ছু পাইনি। খালি চেয়ারম্যান আইয়া দেখে গেছে।’
আমি হতবাক হয়েছি এই জনপদে এত বড় একটা বিপর্যয়, অথচ তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগ ছিল না। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেখে গেছেন অবস্থা; এক-দুজন সদস্যও। উত্তর রনিখাই ইউপির সদস্য চানমিয়া শুকনো মুখে বলেন, ‘প্রতিদিনই উপজেলায় যাই আশায় আশায়। এখন ওপর থেকে না এলে দেব কীভাবে?’
আমার মনে হয় এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষকে খাবার দেওয়া, পানীয়জলের ব্যবস্থা করা। দেখতে পেলাম কজন তরুণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহায্য করতে গেছেন; আমার সঙ্গেও একজন গিয়েছিলেন। যাঁদের সামর্থ্য আছে, সাংগঠনিক যোগ্যতা আছে এভাবে তাঁরাও বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে পারেন। বন্যা চলে যাওয়ার পর যে সংকট দেখা যাবে, বিশেষত মানুষের বসতঘর নির্মাণ, জীবন নির্বাহের পথ খোঁজা, তাতেও সরকারের ভূমিকা নিতে হবে।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
আরও ভালো হয় সরকার যদি এসবের সঙ্গে উদ্যোগী মানুষকে সঙ্গে নেয়। সিলেটের বন্যা থেকে সরকার এই শিক্ষা নিতে পারে যে শুধু আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করা যায় না।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারলে গোটা অঞ্চলের মানুষের জীবনব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। কেননা এমন দুর্যোগ এ অঞ্চলের মানুষ আগে দেখেনি; মোকাবিলা করেনি।
জফির সেতু, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট