এবার হয়নি দুই বাংলার মিলনমেলা

পঞ্চগড়ের অমরখানা সীমান্তে ভারতে থাকা প্রিয়জনদের জন্য আনা উপহারসামগ্রীসহ ফিরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের স্বজনেরা। প্রথম আলো
পঞ্চগড়ের অমরখানা সীমান্তে ভারতে থাকা প্রিয়জনদের জন্য আনা উপহারসামগ্রীসহ ফিরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের স্বজনেরা।  প্রথম আলো

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ থেকে পঞ্চগড়ের অমরখানা সীমান্তে এসেছেন বিষয়া রানী (৩৮)। গত বছর পয়লা বৈশাখে এই সীমান্তে এসেই মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি।

এবারও স্বামী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বিষয়া রানী। মায়ের জন্য নিয়ে এসেছিলেন জীবিত হাঁস, শাড়ি, গুড়-মুড়ি এবং রান্না করা পোলাও ও খাসির মাংস। তাঁর মা থাকেন শিলিগুড়িতে। কিন্তু ভারতের লোকসভা নির্বাচনের কারণে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের পক্ষ থেকে মিলনমেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। গতকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকে বসে থাকতে থাকতে বেলা আড়াইটার দিকে চোখের পানি মুছতে মুছতে স্বজনদের নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।

এভাবে পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলা এবং পাশের জেলাগুলো থেকে আসা হাজার হাজার মানুষকে ফিরে যেতে হয়েছে পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা সীমান্ত থেকে। গতকাল দুপুরে ওই সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিপুলসংখ্যক মানুষ নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে। অমরখানা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পক্ষ থেকে মাইকিং করে মিলনমেলা হবে না জানিয়ে সীমান্তের কাছাকাছি যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। ভারতের অনুমতি না থাকায় কোনো বাংলাদেশি যাতে সীমান্তের কাছাকাছি যেতে না পারেন, সে জন্য মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ ও বিজিবি।

বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এই সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা হয়। এবার ভারতে লোকসভা নির্বাচনের কারণে বিএসএফের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় এবার এ মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।

প্রতিবছরই এই মিলনমেলায় ভারতে থাকা আত্মীয়স্বজনের জন্য নানা উপহারসামগ্রী নিয়ে হাজির হন বাংলাদেশিরা। সেখানে কেউ কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে, কেউবা এপার থেকে ওপারে ছুড়ে আবার কেউবা লম্বা কোনো বাঁশ দিয়ে কাঁটাতারের ওপর দিয়ে উপহারসামগ্রী বিনিময় করেন। শুধু আবেগী এই দৃশ্য দেখার জন্যও অনেকে ছুটে আসেন এখানে। সীমান্তে বসে নানা উপহারসামগ্রীর দোকান। তবে এবার নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে দুই দেশে থাকা স্বজনদের।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির আগে পঞ্চগড়ের সদর, তেঁতুলিয়া, বোদা এবং দেবীগঞ্জ উপজেলা ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অধীনে ছিল। বিভক্তির পর এসব এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। দেশ বিভাগের কারণে এখানকার অনেক পরিবার ও আত্মীয়স্বজন দুই দেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দুই দেশের নাগরিকেরা তাঁদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়া–আসার সীমিত সুযোগ পেলেও ভারত তাদের সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করায় সে সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে উভয় দেশের নাগরিকদের অনুরোধে প্রায় এক যুগ ধরে বিজিবি ও বিএসএফের সহযোগিতায় অমরখানা সীমান্তে দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

ফেরার সময় ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার সেতাবগঞ্জ থেকে আসা চিনি রানী (৬০) বলেন, ‘আমার মেয়ে আর জামাই আছে শিলিগুড়িতে। জামাই অসুস্থ, তাঁর জন্যই রান্না করে ভাত আর খাসির মাংস নিয়ে এসেছি। পরিবারের সবাই মিলে একটা মাইক্রোবাস সাড়ে তিন হাজার টাকায় ভাড়া করে এখানে এসেছি। কিন্তু তাদের দেখা পেলাম না।’

অমরখানা ইউপির চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান বলেন, বিজিবি এবং বিএসএফের পতাকা বৈঠকে বিএসএফ তাদের নির্বাচনের কারণ দেখিয়ে মিলনমেলা হবে না বলে জানায়। পরে এই খবর সবাইকে জানানোর জন্য ইউপির পক্ষ থেকে ইউনিয়নজুড়ে মাইকিং করা হয়।

পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এরশাদুল হক বলেন, ভারতে লোকসভা নির্বাচনের কারণে বিএসএফ তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মিলনমেলা হবে না বলে বিজিবিকে চিঠি দিয়ে জানায়। তাই এবার সীমান্তে মিলনমেলা হচ্ছে না।