দাম কত—উৎসুক জনতার একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে রীতিমতো হয়রান হয়ে গেছেন খামারি ইসলাম উদ্দিন। তাঁর চারপাশে ২০–২৫ জনের জটলা। মুঠোফোনে কেউ ছবি তুলছেন, কেউ সেলফিও তুলছেন, কেউবা ভিডিও করছেন। তবে কোনো ছবি, সেলফি বা ভিডিওতে খামারি ইসলামের ‘ঠাঁই’ হচ্ছে না। তাঁর সঙ্গে থাকা ‘বিগ বস’ নিয়েই সবার আগ্রহ। রাজধানীর গাবতলীর পশুর হাটে গতকাল বুধবার সবার আগ্রহের শীর্ষে ছিল কালো রঙের বিশাল আকৃতির গরু বিগ বস।
খামারি এই গরু এনেছেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে। এই গরুর বয়স চার বছর। লম্বায় ১০ ফুট, উচ্চতা ৬ ফুট। এর ওজন ১ হাজার ৭৫০ কেজি। খামারি দাম চাইছেন ৩০ লাখ টাকা। গত মঙ্গলবার গাবতলী হাটে আনা এই গরুর দাম গতকাল বিকেল পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৯ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।
বিগ বসের মতো রাজধানীর অন্যান্য পশুর হাটেও বড় আকৃতির গরু উঠেছে। এসব গরুর দাম জানতে ক্রেতাদের যতটা আগ্রহ দেখা গেছে, কেনার জন্য সেই আগ্রহ খুব একটা দেখা যায়নি। তবে এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে ছোট ও মাঝারি আকৃতির গরুর ক্ষেত্রে। দাম জানতে চাওয়ার পাশাপাশি গতকাল অনেকে ছোট ও মাঝারি আকৃতির গরু কিনেছেন।
গাবতলী হাটে কথা হয় জামালপুরের মাদারগঞ্জের ব্যাপারী আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি ১৭টি গরু নিয়ে গত মঙ্গলবার হাটে এসেছেন। গতকাল বিকেল পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি। তাঁর আনা একেকটি গরুর ওজন তিন থেকে সাত মণ।
আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, এখনো ক্রেতা খুবই কম। যাঁরা আসছেন, তাঁরা শুধু দাম জানতে চাইছেন। দাম শোনার পর কিছু না বলেই চলে যাচ্ছেন। ক্রেতারা এখন শুধু বাজার ঘুরে দাম সম্পর্কে ধারণা নিচ্ছেন।
আবুল কালাম তিন মণ ওজনের একেকটি গরুর দাম চাইছেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর সাত মণ ওজনের একেকটি গরুর জন্য ৩ লাখ টাকা দাম চাইছেন।
কয়েকদিন আগে থেকেই রাজধানীর হাটগুলোতে কোরবানি পশু আনা হলেও গতকাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কেনাবেচা শুরু হয়েছে। এবার ঢাকা উত্তর সিটিতে অস্থায়ী ৯টি পশুর হাট বসেছে। দক্ষিণ সিটিতে বসেছে ১০টি পশুর হাট।
উত্তর সিটিতে পশুর হাট বসেছে আফতাবনগর (ব্লক ই থেকে এইচ), কাওলা শিয়ালডাঙ্গা, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর (বৃন্দাবন এলাকা), ভাটারা (সাইদ নগর), মোহাম্মদপুর বছিলা, মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ইস্টার্ন হাউজিং, ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের রহমান নগর আবাসিক প্রকল্প এলাকা, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মাঠ এবং খিলক্ষেতে (জামালপুর প্রোপার্টিজের খালি জায়গা)। এর বাইরে গাবতলীর স্থায়ী পশুর হাট।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির অস্থায়ী ১০টি হাট হচ্ছে খিলগাঁও রেলগেটসংলগ্ন মৈত্রী ক্লাব সংঘ মাঠ, হাজারীবাগের ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজ মাঠ, পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসহ আশপাশের খালি জায়গা, মেরাদিয়া বাজারসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, কমলাপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন এলাকা, দনিয়া কলেজসংলগ্ন আশপাশের এলাকা, ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালসংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা, লালবাগে রহমতগঞ্জ ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, শ্যামপুর কদমতলী ট্রাকস্ট্যান্ডসংলগ্ন খালি জায়গা এবং আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গা। এর বাইরে ডেমরার সারুলিয়া বাজারের স্থায়ী হাট।
গতকাল দুপুরে খিলগাঁও রেলগেটসংলগ্ন হাট ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতা কম। যাঁরা এসেছেন, তাঁদের বড় অংশই দরদাম করে চলে যাচ্ছে। এই হাটের মূল আকর্ষণ ‘রাজা বাবু’। এর ওজন ৩৭ মণ বলে জানান বিক্রেতা সানোয়ার হোসেন। তিনি গরুর দাম হাঁকাচ্ছেন ১৫ লাখ টাকা। তাঁর দাবি, একজন ক্রেতা ইতিমধ্যে ৭ লাখ ২০ হাজার বলে গেছেন। তবে এই টাকায় তিনি গরু ছাড়বেন না।
জামালপুরের ইসলামপুরের খামারি সানোয়ার হোসেন গত বছর রাজধানীর আফতাবনগর হাটে ২৩ মণ ওজনের একটি গরু এনেছিলেন। দাম চেয়েছিলেন ৫ লাখ টাকা। কিন্তু ঈদের আগের দিন গরুর দাম কমে যাওয়ায় আর বিক্রি করতে পারেননি। সেই গরু এখনো তাঁর খামারে আছে। এবার সেই গরু আর ঢাকায় বিক্রির জন্য আনেননি।
খিলগাঁও রেলগেটসংলগ্ন হাটে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলা থেকে মাঝারি আকৃতির ১৬টি গরু নিয়ে এসেছেন চারজন ব্যাপারী। তাঁরা সাড়ে তিন মণ ওজনের একেকটি গরুর দাম চাইছেন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। চারজন ব্যাপারীর মধ্যে দুজন নূর আলম ও হামিদুর রহমান বলেন, এবার ছোট গরুর চাহিদা বেশি হওয়ায় দামও বেশি। সে তুলনায় মাঝারি আকারের গরুর দাম কিছুটা কম। এখন পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি হয়নি জানিয়ে তাঁরা বলেন, ঢাকায় রাখার জায়গা না থাকায় অনেকেই ঈদের আগের দিন গরু কেনেন।
এই হাটে গতকাল দুপুরে গরু কিনতে আসা খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা খালিদ সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এবার এখনো গরুর দাম বেশ চড়া। তবে ঈদের এক–দুই দিন আগে দাম আরেকটু কমতে পারে। তিনি বলেন, তাঁর বাজেট ৭০ হাজার টাকা। এই টাকায় মাঝারি আকারের গরু না পেলে ছোট আকারের গরু কিনবেন।
খিলগাঁওয়ের এই হাট মূলত শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির ভেতরে বসে। কলোনির ভেতরে গরুর হাট বসানোর কারণে এখানকার বাসিন্দাদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
দক্ষিণ সিটির আওতাধীন কমলাপুর রেলস্টেশনসংলগ্ন আরেকটি হাটে গতকাল বিকেলে গিয়ে দেখা গেছে, এখানেও ক্রেতার উপস্থিতি খুব একটা নেই। যাঁরাই হাটে আসছেন, দরদাম বোঝার চেষ্টা করছেন।
এই হাঁটে বিশালাকৃতির বেশ কয়েকটি গরু উঠেছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর থেকে ৩৫ মণ ওজনের একটি গরু এনেছেন মো. রায়হান। এই গরুর নাম দিয়েছেন ‘বড় ভাই’। এই ব্যাপারী বলেন, দেশের ধনী লোকেরা ঢাকায় বসবাস করেন। তাই ‘উপযুক্ত’ ক্রেতা পাওয়ার আশায় এবারই প্রথম গরু নিয়ে তিনি ঢাকায় এসেছেন তিনি।
কমলাপুর হাটের ইজারাদার গোলাম কিবরিয়া খান প্রথম আলোকে বলেন, হাটে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার পশু এসেছে। এর মধ্যে গতকাল বিকেল পর্যন্ত শ খানেক গরু বিক্রি হয়েছে।
এদিকে করোনা মহামারির প্রকোপ বাড়লেও পশুর হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা দেখা যায়নি। ব্যাপারী, খামারি ও ক্রেতাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। এমনকি হাটের প্রবেশমুখে তাপমাত্রা মাপার কোনো ব্যবস্থাও দেখা যায়নি।