নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পক্ষে সংস্থার পরিদর্শক বাদী হয়ে ঢাকায় নৌ আদালতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা করেছেন।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় অবশেষে নৌ আদালতে মামলা হয়েছে। তবে মৃত্যুর দায় কার, সেটি নৌপরিবহন অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়নি। গতকাল রোববার দুপুরে মামলা করার পরই লঞ্চটির চার মালিকসহ আটজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন নৌ আদালত। অন্য চার আসামি হলেন লঞ্চটির চারজন মাস্টার (চালক) ও ড্রাইভার (ইঞ্জিন পরিচালনায় নিযুক্ত কর্মী)।
মামলায় বলা হয়েছে, লঞ্চটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, বয়া ও বালুর বাক্স ছিল না। এ ছাড়া ইঞ্জিন কক্ষের বাইরে অননুমোদিতভাবে ডিজেলবোঝাই বেশ কয়েকটি ড্রাম রাখা ছিল। ইঞ্জিন কক্ষের পাশে রান্নার জন্য গ্যাসের সিলিন্ডার (বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ) রাখা হয়েছিল। একই সঙ্গে লঞ্চটি অননুমোদিত লোকবল দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছিল বলেও মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
নৌ আদালতে মামলাটি করেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরে প্রধান পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান। চলন্ত লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে এবং নদীতে ডুবে ৩৮ জনের মৃত্যুর পরও মামলায় মৃত্যুর দায়ের বিষয়টি কেন উল্লেখ করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের পরিদর্শকের প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে মামলাটি করা হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুজনিত দায় নির্ধারণ করে সম্পূরক মামলা করা হবে।
যেসব অভিযোগে নৌ আদালতে মামলা হয়েছে, তাতে অপরাধ প্রমাণ হলে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় ধরনের দণ্ড।
■ পুড়ে যাওয়া লঞ্চের চারজন মালিকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ■ নৌ আদালতে অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড।
অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ (১৯৭৬) অনুযায়ী, দুর্ঘটনার মামলা হওয়ায় অভিযান-১০ লঞ্চের ফিটনেস সনদ, নিবন্ধন এবং মাস্টার-চালকদের সনদ স্থগিত করেছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে লঞ্চটির নিবন্ধনসহ সব সনদ বাতিল হয়ে যেতে পারে।
মামলার আসামিরা হলেন লঞ্চের চার মালিক মো. হামজালাল শেখ, মো. শামিম আহম্মেদ, মো. রাসেল আাহাম্মেদ ও ফেরদৌস হাসান। এর মধ্যে হামজালালের অধীনে লঞ্চটির ৫০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। বাকি তিনজনের কাছে রয়েছে ৫০ শতাংশের মালিকানা। অন্য আসামিরা হলেন লঞ্চের ইনচার্জ মাস্টার মো. রিয়াজ সিকদার, ইনচার্জ চালক মো. মাসুম বিল্লাহ, দ্বিতীয় মাস্টার মো. খলিলুর রহমান ও দ্বিতীয় চালক আবুল কালাম।
এদিকে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বরগুনার আদালতে হামজালাল শেখকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা হয়েছে। মামলাটি করেছেন বরগুনা সদর উপজেলার বালিয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল ইসলাম। তিনি বালিয়াতলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। আদালতের সংশ্লিষ্ট থানাকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির নয়টি ধারায় বেপরোয়া নৌযান চলাচল, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই নৌযান পরিচালনা ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অবশ্য নৌ আদালতের আইনজীবীরা জানান, নৌ দুর্ঘটনার বিচারের মামলা নৌ আদালতের বাইরে হওয়ার সুযোগ নেই। নৌ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অন্য আইনে থানায় বা আদালতে (নৌ আদালত নয়) মামলা হলে অভিযুক্ত মালিক-কর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগে পার পেয়ে যান। নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে নৌ পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে এ বিষয়ে চিঠি দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না।
সারা দেশের নৌ দুর্ঘটনার বিচারে একটি মাত্র নৌ আদালত রয়েছে ঢাকায়। নৌ আদালতের আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে নৌ আদালত প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনার মামলা হয়েছে ৫২৬টি। গত চার বছরে মাত্র ১টি মামলার রায় হয়েছে। এখনো ১৪৭টি দুর্ঘটনার মামলা বিচারাধীন। তবে দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য (নৌ শৃঙ্খলা ভঙ্গ) মামলা মিলে ৩ হাজারের মতো মামলা নৌ আদালতে বিচারাধীন। এই আদালতে বিচারক মাত্র একজন।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধনকৃত নৌযানের সংখ্যা ১৩ হাজার ৪৮৬টি। তবে বেসরকারি হিসাবে সারা দেশের অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা লাখের বেশি।
গত বৃহস্পতিবার অভিযান-১০ লঞ্চ যখন ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে ছেড়ে যায়, তখন এর ভয়েজ ডিক্লারেশন (যাত্রা শুরুর অনুমতি/ঘোষণা) দেন বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক দীনেশ কুমার সাহা। তিনি লঞ্চের যাত্রীর সংখ্যা ৩১০ জন উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া লঞ্চটিতে কোনো ত্রুটি নেই বলেও উল্লেখ করেন।
কিন্তু দুর্ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের অনেকেই বলেছেন, লঞ্চটিতে আট শতাধিক যাত্রী ছিল। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিও প্রাথমিকভাবে লঞ্চটিতে ত্রুটি পেয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে দীনেশ কুমার সাহা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। আর বিআইডব্লিউটিএর অন্য কর্মকর্তারা বলছেন, মালিকেরা দায় এড়াতে এখন নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে তদন্তে কোনো পরিদর্শকের অনিয়মের বিষয়টি বেরিয়ে এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক লঞ্চের মালিক প্রথম আলোকে বলেন, পরিদর্শকেরা কদাচিৎ লঞ্চে সশরীর পরিদর্শন করে যাত্রা শুরুর অনুমতি দেন। প্রতি যাত্রায় প্রতি লঞ্চ থেকেই পরিদর্শকেরা টাকা নেন বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা।
এদিকে লঞ্চের অগ্নিকাণ্ডের কারণ বের করতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। রিটে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা এবং গুরুতর আহতদের ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ চাওয়া হয়েছে। রিটে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ও লঞ্চের মালিককে বিবাদী করা হয়েছে।
এদিকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল দুপুরে বরগুনা সার্কিট হাউসের সম্মেলনকক্ষে ২২ জন প্রত্যক্ষদর্শীর লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য নিয়েছে।
অভিযান-১০ লঞ্চের যাত্রী বেতাগী পৌরসভার বাসিন্দা মো. সাহেব আলী লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন, লঞ্চটির ইঞ্জিনের সমস্যার কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।
আরেক যাত্রী মো. সানাউল্লাহ বলেন, লঞ্চটির ইঞ্জিন থেকে অস্বাভাবিক জোরে শব্দ হচ্ছিল। যাত্রীদের কয়েকজন বিষয়টি চালকের কাছে জানতে চান। চালক বলছিলেন কোনো সমস্যা নেই, ইঞ্জিনে কাজ করানো হয়েছে। একজন ইঞ্জিনিয়ার লঞ্চে আছেন।
তদন্ত দলের সদস্যসচিব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এসব বক্তব্য তাঁরা বিশ্লেষণ করবেন। লঞ্চের যে জায়গা থেকে আগুনের সূত্রপাত বলা হচ্ছে, তা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হবে। সবকিছু বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবে তদন্ত কমিটি।