চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বাবুডাইং, ফিলটিপাড়া ও চিকনা গ্রামে কোল ভাষায় এখন তিনটি স্কুল। দেশে কোল জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা দুই হাজারের মতো। বেশির ভাগেরই বাস উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোয় মাতৃভাষায় প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে।
বাবুডাইংয়ে এমন একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বললেন, ‘আমাদের ছেলেরা আগে স্কুলেই যেতে চাইত না। কারণ, বাংলা বুঝত না, সমস্যা হতো। তারপর কোল ভাষায় বর্ণমালা তৈরি হলো। পাঠ্যক্রম তৈরি করে স্কুল হওয়ার পর এখন ছেলেমেয়েদের যাতায়াত শুরু হয়েছে।’
মাতৃভাষায় কথা বললেও কোলদের কোনো বর্ণমালা ছিল না। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস (সিল) কোল ভাষায় বর্ণমালা তৈরি শুরু করে। এরপর শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা নয়, নিজ ভাষায় কবিতা, ছড়া, গান লেখার চল শুরু হয়েছে বলে জানালেন শিক্ষক নির্মল কোল। তাঁর কথা, নিজ ভাষায় লেখার যে মজা, তা বলে বোঝানো যাবে না।
শুধু কোল ভাষা নয়, ভাষা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সিল কোডা, হাজং, কোচ (তিনটিকিয়া), মাহালে ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের ভাষার বর্ণমালা তৈরি করেছে। এতে এসব ভাষায় নতুন শিক্ষা–উপকরণ তৈরি হওয়া ছাড়াও উচ্চারণে সমস্যা কেটেছে, নতুন নতুন ধ্বনি তৈরি হয়েছে, ভাষাগুলোকে আরও ব্যবহার–উপযোগী করে তোলা হয়েছে।
এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বর্ণমালা তৈরির উদ্যোগ কেন? সিলের বাংলাদেশীয় পরিচালক কর্নেলিয়াস টুডু বলেন, এমনিতেই এসব জাতির মানুষের সংখ্যা কম। কোনো ভাষার যদি বর্ণমালা না থাকে, তবে সেগুলো আরও নাজুক অবস্থায় থাকে।
সিলের গবেষকদের কথা, বাংলাদেশের প্রতিটি জাতিসত্তার ভাষাই আসলে বিপন্ন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিশম্যান মানদণ্ডের কথা উল্লেখ করেন। এই মানদণ্ডের পুরো নাম গ্রেডেড ইন্টারজেনারেশনাল ডিসরাপশন স্কেল (জিআইডিএস)। কোনো ভাষার মান নির্ণয়ে এই মানদণ্ডে আটটি স্তর বিবেচনা করা হয়। বিপন্নতার শুরু যে পঞ্চম স্তরে, সেখানে বিচার্য বিষয়, ভাষাটির মাধ্যমে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি বা ওই ভাষায় সাহিত্য আছে কি না। সিলের জরিপে দেখা গেছে, দেশে সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বড় জাতিসত্তা চাকমাদের সাহিত্য রয়েছে। তবে এই সাহিত্য খুব কম লোক ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য জাতিসত্তার অবস্থা আরও নাজুক।
এই নাজুক অবস্থার মধ্যে থাকলেও চাকমা, মারমা, সাঁওতালদের মতো বড় জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব বর্ণমালা আছে। আর যেসব জাতিগোষ্ঠীর বর্ণমালা নেই, তাদের বিপন্নতার পরিমাণ আরও বেশি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান।
সিল কোনো ভাষার বর্ণমালা তৈরির ক্ষেত্রে স্মলি ম্যাট্রিকস বা স্মলির কাঠামো নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক আরেক পদ্ধতির সহায়তা নেয়। এখানে পাঁচটি বিষয় বিবেচনা করা হয় বলে জানান তিনি। সেগুলো হলো সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা, (বেশির ভাগ মানুষ এই বর্ণমালা সমর্থন করে) সর্বাধিক প্রতিনিধিত্বকারী, (বেশির ভাগ শব্দ এখানে ধারণ করা হয়েছে), শেখার জন্য সহজ, অন্য ভাষায় প্রতিস্থাপন করা যায় এবং উপকরণ তৈরির জন্য সহজ।
কোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষের একটি দলকে প্রথমে এক জায়গায় করে তাদের লিখতে বলা হয়। যারা লিখতে পারে না, তারা কথা বলে। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় বাংলাতেই তারা লেখে বা বলে। এরপর তাদের করা উচ্চারণের সঙ্গে সমমানের ধ্বনি খোঁজা হয়। তা না পেলে নতুন বর্ণের সঙ্গে কিছু যুক্ত করে নতুন ধ্বনি তৈরি করা হয়। বেশ কয়েকবারের দলভিত্তিক কর্মশালায় এসব কাজ করা হয়।
সিল যে ছয়টি ভাষার বর্ণমালা তৈরি করেছে, এর মধ্যে চারটিকে হরফ হিসেবে বাংলা বেছে নেওয়া হয়েছে। মাহালে ও কোল ভাষার বর্ণমালায় রোমান হরফ নেওয়া হয়েছে। কোন জাতি কোন হরফ নেবে, সেটি সেই জাতির ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই হরফ বেছে নেওয়া হয়।
সিলের বর্ণমালা তৈরির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো একটি ধ্বনির জন্য একটি প্রতীকই ব্যবহার করা হয়। এটি ভাষাকে সহজ করার জন্যই করা হয়।
ভাষাতাত্ত্বিক সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান বলেন, একটি প্রতীকে একটি ধ্বনির ব্যবহার যদি সিল করে থাকে, তবে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর প্রায় ৯৯ শতাংশ ভাষাতেই এক ধ্বনিতে একাধিক প্রতীকের ব্যবহারের রীতি রয়েছে।
বর্ণমালা তৈরিতে হারিয়ে যাওয়া শব্দ ফিরে আসছে। এর উদাহরণ দিলেন রুয়েল চন্দ্র কোচ। তাঁর বাড়ি শেরপুরের ঝিনাইগাতীর শালচূড়া গ্রামে। তিনি বললেন, ‘আমাদের ভাষায় “আলু”কে বলে “বেলটেখান”। নতুন প্রজন্ম এ শব্দ জানতই না। এখন বর্ণমালা তৈরি হওয়ায় শব্দটির অনেক ব্যবহার লক্ষ করেছি।’
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষার সুরক্ষা এবং তাদের প্রয়োজন মেটাতে বর্ণমালা নানাভাবে সহায়ক হচ্ছে। এরপরও এভাবে বর্ণমালা তৈরি ভাষাতত্ত্বের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যেমন সিল বলেছে, প্রতিটি ভাষার বর্ণমালা তৈরি করতে গিয়ে তারা গড়পড়তা ৬ থেকে ১০টি নতুন নতুন ধ্বনির সন্ধান পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর মনে করেন, এসব নতুন ধ্বনির উদ্ভব এবং এগুলোর সংরক্ষণ ভাষাতত্ত্বের উৎকর্ষ বাড়াবে। একে ‘বৈশ্বিক সম্পদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি।