এখনই জট, ঈদে স্বস্তির আশা কম

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় চারটি নয়, ফেরি বাড়বে তিনটি। শিমুলিয়া-বাংলাবাজারে রাতে ফেরি চালানোর সিদ্ধান্ত আসেনি।

ফেরি কম থাকায় গোয়ালন্দ ঘাট এলাকায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি। গতকাল ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের চৌধুরী ওয়াজেদ আলী টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে

পবিত্র ঈদুল ফিতর ঘনিয়ে এলেও পদ্মা নদী পাড়ি দিতে ফেরিঘাট পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। পদ্মার ওপারে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটে গতকাল শুক্রবার যাত্রীবাহী বাস ও পচনশীল পণ্যবাহী ট্রাকের সারির দৈর্ঘ্য ছিল সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের মতো। আর এপারে গতকাল দিনের প্রথমভাগে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় দুই কিলোমিটার সড়কে কয়েক শ বাস ফেরির জন্য অপেক্ষায় ছিল। ট্রাকের সারি আলাদা।

ঈদে শুধু এই ঘাট দিয়েই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার যাত্রী নিয়ে বাস ও অন্যান্য যানবাহন চলাচল করবে। কারণ, পদ্মা পাড়ির জন্য মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার ঘাট দিয়ে ফেরি চললেও তাতে বাস পারাপার করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ঈদের আগে এখনকার তুলনায় তিনটি ফেরি বাড়বে। ফেরি ভেড়ানোর ঘাট বাড়বে একটি করে। ঈদের ছুটির মধ্যে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।

এর আগে ১০ এপ্রিল প্রথম আলোতে এই দুই ফেরিঘাট নিয়ে ‘ঈদের আগেই চরম দুর্ভোগ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ঈদের আগে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় ৪টি ফেরি বাড়বে। চলবে ২২টি ফেরি। দেখা যাচ্ছে, আগের পরিকল্পনার চেয়ে ফেরি একটি কম পাচ্ছে এই ঘাট।

বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজী প্রথম আলোকে বলেন, এখন সারা দেশে চলছে ৪৫টি ফেরি। ঈদের ছুটি শুরুর পর চলবে ৪৯টি। তখন সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে। এতে যানজট কমবে বলে আশা করেন তিনি।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন যেখানে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে দুই পারে যানবাহনের বিশাল জট, সেখানে ঈদের সময় সামান্য সক্ষমতা বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। এবার ঈদে গত দুই বছরের চেয়ে মানুষ গ্রামের বাড়িতে বেশি যাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, এবার করোনার প্রকোপ নেই।

এবার ঈদে ছুটি শুরু হবে ২৮ এপ্রিল থেকে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ঈদ হতে পারে আগামী ২ অথবা ৩ মে।

ফেরিঘাটে সরেজমিন

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটের পাটুরিয়া অংশে ফেরি ভেড়ানোর ঘাট পাঁচটি। এর মধ্যে চারটি সচল। একটির পল্টুন মেরামত চলছে, যা দু-এক দিনের মধ্যে ঘাটে বসবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

দৌলতদিয়া অংশে ফেরি ভেড়ানোর ঘাট সাতটি। বন্ধ তিনটি ঘাটের একটি ২০১৯ সালে নদীভাঙনে বিলীন হয়। আরেকটিতে ফেরি ভেড়ার মতো পানির গভীরতা নেই। তৃতীয়টিতে সিমেন্টবোঝাই কার্গো ভেড়ে, ফেরি নয়।

সচল চারটি ঘাটের মধ্যে দুটি কার্যত ফেরি ভেড়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে (৫ ও ৭ নম্বর)। একটি ঘাট (৩ নম্বর) একটু দূরে হওয়ায় সেটি ব্যবহারে আগ্রহী নন ফেরির চালকেরা। তাঁরা ৫ ও ৭ নম্বর ঘাটে ফেরি ভেড়ানোর জন্য খালি হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকেন। আরেকটি ঘাট (৪ নম্বর) সাধারণত ‘ভিআইপি’দের যানবাহন বহনকারী ফেরি ভেড়াতে ব্যবহার করা হয় বলে জানান এই ঘাটের পন্টুনের দায়িত্বে থাকা সারেং শামিম তরফদার।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটের নৌপথে মাস দু-এক ধরে একটি ডুবোচর টের পাচ্ছেন ফেরিচালকেরা। খনন (ড্রেজিং) করে চরটি অপসারণ করা হলে ফেরি চলাচল সহজ হতো। তবে সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

দৌলতদিয়া ঘাটে দেখা যায়, যাত্রীবাহী বাস ও পচনশীল পণ্যবাহী যানবাহন অগ্রাধিকারভিত্তিতে ফেরিতে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। তবে চার ঘণ্টা অপেক্ষার আগে তারা ফেরিতে উঠতে পারছে না। সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাককে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা।

কুষ্টিয়া থেকে তামাক নিয়ে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে গোয়ালন্দের চৌধুরী ওয়াজেদ আলী টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পৌঁছান ট্রাকচালক রাকিবুল ইসলাম। পরদিন গতকাল দুপুর ১২টার দিকে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে একই জায়গায় আটকে আছি। আজ (শুক্রবার) নদী পাড়ি দিতে পারব বলে মনে হয় না।’

শিমুলিয়া-বাংলাবাজার

সড়কপথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেতে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার দ্বিতীয় নৌপথ মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাট। এই পথে গত আগস্ট থেকে ফেরিতে যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাক পারাপার বন্ধ রয়েছে। এবার ঈদেও তা বন্ধ থাকবে। এই পথ দিয়ে ব্যক্তিগত যানবাহন ও যাত্রীরা পারাপার হতে পারবেন।

শিমুলিয়া-বাংলাবাজার পথে বাস-ট্রাক পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ফেরি পদ্মা সেতুতে ধাক্কা দেওয়ায়। তখন এই পথে রাতে ফেরি চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ফেরি সরিয়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় নেওয়া হয়। অবশ্য সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ঘাট নামে একটি ঘাট করা হয়েছে। শিমুলিয়া থেকে রওনা দিয়ে ফেরি বাংলাবাজারের বদলে সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ঘাটে ভিড়তে পারে। সমস্যা হলো, এই ঘাটের সংযোগ সড়ক সরু।

বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানায়, নৌপথে এখন ৭টি ফেরি চলে। তবে ঈদে তা ১০টি করা হবে।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক গত সোমবার সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ঘাট পরিদর্শনে গিয়ে ঘোষণা দেন যে ঈদে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে রাতে ফেরি চালানো হবে। তবে ঘাটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখনো দিনক্ষণ তাঁদের জানানো হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সেতু বিভাগের সঙ্গে চিঠি চালাচালি চলছে। এদিকে সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ঘাটে নতুন একটি ফেরি ভেড়ানোর ঘাট নির্মাণের কাজ চলছে। ২৮ এপ্রিলের মধ্যে এটি চালু হবে আশা করা হচ্ছে।

সাধারণত বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা থেকে বাস ও অন্যান্য পরিবহনে শিমুলিয়া গিয়ে লঞ্চ ও স্পিডবোটে নদী পার হন। এখন এ নৌপথে ১১৭টি লঞ্চ ও ২৫০টি স্পিডবোট চলাচল করে। অনেকে ফেরিতেও পার হন। ওপারে গিয়ে আবার বাস ও অন্যান্য যানবাহনে গন্তব্যে যান। নিরাপত্তার স্বার্থে রাতে স্পিডবোট চলতে দেওয়া হয় না। দেখা যায়, বাড়তি ভিড়ের সময় মানুষ হুড়মুড়িয়ে ফেরিতে উঠে বসেন। তখন যানবাহন নেওয়ার জায়গা থেকে না।

অনেক যাত্রী ফেরির বিকল্প হিসেবে লঞ্চ ও স্পিডবোট দিয়ে পার হয়ে গন্তব্যে চলে যান। ফেরি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, মানুষ ফেরিতে উঠে বসলেই বিপদ।

বিআইডব্লিউটিসির বাণিজ্য বিভাগের পরিচালক আশিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দেখেছি এ অঞ্চলে যত ছোট যানবাহন চলাচল করবে, তা ১০টি ফেরি দিয়ে পারাপার সম্ভব। কিন্তু ফেরি দিয়ে যাত্রী পারাপারের প্রস্তুতি আমাদের নেই।’

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন অজয় কুণ্ডু, মাদারীপুর]