স্বল্প ব্যয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করে চলেছে একটি বেসরকারি হাসপাতাল।
দেশের একজন শল্যচিকিৎসক এক হাজারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। দেশে এ পর্যন্ত যত কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে, এর এক-তৃতীয়াংশ তাঁর হাত দিয়ে হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা একে বড় ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন।
এই শল্যচিকিৎসক হলেন মো. কামরুল ইসলাম। দেশের মানুষ কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য যখন বিদেশ যেতে উন্মুখ, তখন স্বল্প ব্যয়ে তিনি একের পর এক কিডনি প্রতিস্থাপন করে চলেছেন। করোনা মহামারির সময় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার প্রায় বন্ধ থাকলেও কিডনি প্রতিস্থাপন বন্ধ রাখেননি তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে মহামারির সময়ে ২৫৫টি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
রাজধানীর শ্যামলীতে হাসপাতালটি যাত্রা শুরু করে ২০০৭ সালে। তখন থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু। প্রতিস্থাপন শল্যবিদ বা ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন কামরুল ইসলাম ১৯ অক্টোবর এক হাজার কিডনি প্রতিস্থাপনের মাইলফলক স্পর্শ করেন।
এ ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা হারুন-অর-রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিপুল সংখ্যায় কিডনি প্রতিস্থাপন করার জন্য অধ্যাপক কামরুল ইসলামকে অভিনন্দন জানাই। তাঁর এই সাফল্য নবীন শল্যচিকিৎসকদের অনুপ্রাণিত করবে। তাঁকে অনুসরণ করে দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিয়মিত কিডনি প্রতিস্থাপনে তৎপর হবে বলে আশা করি।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনি প্রতিস্থাপন একটি জীবনদায়ী শল্যচিকিৎসা। মানুষের দুটি কিডনি থাকে। জটিল ও দীর্ঘদিন কিডনি রোগে ভুগলে মানুষের কিডনি অকেজো হয়ে যায়। তখন অন্যের শরীর থেকে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। কিডনি বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ দাবি করেন, একটি কিডনি নিয়েও মানুষ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারেন।
১৯৮২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। এর বাইরে সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়। বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে আছে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল, বারডেম, কিডনি ফাউন্ডেশন, পপুলার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল। তবে সব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কিডনি প্রতিস্থাপিত হয় না। ঢাকার বাইরে শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
কিডনি প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন, দেশে এমন রোগীর সংখ্যার তুলনায় প্রতিস্থাপন করার সুযোগ-সুবিধা কম। গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায়, দেশের বহু মানুষ কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে যান। বিদেশে এই চিকিৎসার খরচও অনেক বেশি। প্রতিবেশী দেশ ভারতে গেলে সব মিলে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ হয়। অনেকে প্রতারণারও শিকার হন।
সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন চিকিৎসায় নেওয়া হয় ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। এই খরচের মধ্যে কিডনিগ্রহীতা ১৪ দিন আইসিইউতে থাকতে পারেন, কিডনিদাতাও প্রয়োজনীয় পাঁচ-ছয় দিন হাসপাতালে থাকতে পারেন। ওষুধের জন্য বাড়তি খরচ করতে হয় না।
২৩ অক্টোবর রাতে ওই হাসপাতালে কথা হয় অধ্যাপক কামরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখে আমি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করছি। যাঁদের অর্থকড়ি আছে, সামর্থ্য আছে, তাঁরা বিদেশে গিয়ে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাতে পারেন। যাঁরা যেতে পারেন না, আমি তাঁদের জন্য কাজ করছি।’
অধ্যাপক কামরুল ইসলামের সঙ্গে চিকিৎসক-নার্সদের একটি দল কিডনি প্রতিস্থাপনে যুক্ত থাকে। যেমন হাজারতম কিডনি প্রতিস্থাপনে যুক্ত ছিলেন ১৪ জন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিস্থাপনের সময় একজন চিকিৎসক কিডনিদাতার শরীরে অস্ত্রোপচার করেন, একজন চিকিৎসক রোগী বা কিডনিগ্রহীতার শরীরে অস্ত্রোপচার করেন।
কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি একাই কিডনি নেওয়া ও সংযোজন করেন। প্রতিটি অস্ত্রোপচারে গড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। হাসপাতালে এখন সপ্তাহে তিনটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়। এই সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।
মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৮-এ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগ্রহীতার ও দাতার প্রত্যেকের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংরক্ষণ করার কথা বলা আছে। সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের সঙ্গে জড়িত গ্রহীতা ও দাতার প্রত্যেকের তথ্য রেজিস্টারে লেখা হয় ও সংরক্ষণ করা হয়। বছর শেষে তাঁরা এই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখায় জমা দেন। কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সাফল্যের হার ৯৫ শতাংশ।
কামরুল ইসলামের জন্ম পাবনার পাকশীতে। ১৯৮৯ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরে তিনি যুক্তরাজ্য থেকে এফআরসিএস ডিগ্রি নেন। এ ছাড়া আরও একাধিক উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে তাঁর। কামরুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ তিনি নিয়েছেন ভারতে একাধিক বড় প্রতিষ্ঠানে।
৫৬ বছর বয়সী এই অধ্যাপক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, ‘প্রতিস্থাপনের পর কিডনিদাতাদের প্রতি নজর কম থাকে। তাই তাঁরা যেন ভালো থাকেন, সে জন্য কিছু করার ইচ্ছা আছে। ভবিষ্যতে এই হাসপাতালে কিডনিদাতারা বিনা মূল্যে সব ধরনের কিডনি রোগের চিকিৎসা পাবেন। দাতাদের কারও শরীরে কিডনি সংযোজনের দরকার পড়লে তা-ও বিনা মূল্যে করা হবে।’
এক হাজারতম কিডনি প্রতিস্থাপনের পর থেমে যাননি অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। গতকাল মঙ্গলবারও তিনি একজন রোগীর শরীরে কিডনি সংযোজন করেছেন। এই নিয়ে সংখ্যা দাঁড়াল ১ হাজার ৪।