করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশ–বিদেশের বিশেষজ্ঞরা রোগী শনাক্তকরণে পরীক্ষা বাড়ানোর ওপর জোর দিলেও বাংলাদেশে সেটা কমে গেছে। গত এক মাসেই করোনা পরীক্ষা কমেছে ২৬ শতাংশ।
তথ্য–উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ মাসের (৮ জুন থেকে ৭ জুলাই) চেয়ে পঞ্চম মাসে (৮ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট) ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫০টি পরীক্ষা কম হয়েছে, যা ২৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বুঝতে হলে এই সময়ে দিনে অন্তত ২০ হাজার পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের করোনাবিষয়ক পুরো কার্যক্রমেই একটা গা ছাড়া বা ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। পরীক্ষার সংখ্যা হঠাৎ কমে যাওয়ায় সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না।
>দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ মাসের চেয়ে পঞ্চম মাসে ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫০টি পরীক্ষা কম হয়েছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বুঝতে হলে এই সময়ে দিনে অন্তত ২০ হাজার পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল
আজ শনিবার দেশে সংক্রমণের ষষ্ঠ মাস শুরু হয়েছে। পঞ্চম মাসে বাংলাদেশে পরীক্ষা কমলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে এই সময়ে পরীক্ষা বেড়েছে। বিশেষ করে ভারতে গত জুন মাসের শেষ থেকে পরীক্ষা বেড়েছে ব্যাপকভাবে, একই সঙ্গে দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়েছে।
দুই লাখের বেশি করোনা (কোভিড-১৯) শনাক্ত রোগী রয়েছেন, বাংলাদেশসহ এমন দেশ এখন ১৯টি। আক্রান্তের এই শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম করোনা পরীক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের চেয়েও কম পরীক্ষার দেশ ছিল মেক্সিকো। এখন বাংলাদেশ মেক্সিকোর চেয়েও পিছিয়ে।
গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট করোনা পরীক্ষা হয়েছে ১২ লাখ ৩৭ হাজার ৮২৩ জনের। এর মধ্যে সংক্রমণের চতুর্থ মাসে অর্থাৎ, গত ৮ জুন থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত দেশে পরীক্ষা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯৩ জনের। আর পঞ্চম মাসে পরীক্ষা হয়েছে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৭৪৩টি। আগের মাসে চেয়ে ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫০টি পরীক্ষা কম হয়েছে। দেশে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ১৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত
হন ২ জুলাই। ওই দিন নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৬২টি। এরপর থেকে নমুনা পরীক্ষা ও রোগী শনাক্ত—দুটোই কমেছে। এ সময়ে পরীক্ষার ফি চালুর পাশাপাশি সন্দেহভাজন রোগীর জ্বর, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট—এই চার উপসর্গ না থাকলে অনেক জায়গায় নমুনা নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।
দক্ষিণ এশিয়ায়ও বাংলাদেশ পিছিয়ে
পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস শুরু থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে আসছে। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কোভিড-১৯ শনাক্তের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে ৭ হাজার ৫০৯ জনের করোনার পরীক্ষা করা হচ্ছে।
ওয়ার্ল্ডোমিটারসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুই লক্ষাধিক আক্রান্ত আছে এমন দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশে।
দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে কেবল আফগানিস্তানে। দেশটিতে প্রতি ১০ লাখে ২ হাজার ৩২৯ জনের পরীক্ষা হচ্ছে। এর বাইরে ভারতে প্রতি ১০ লাখে ১৬ হাজার ৪৯৭, পাকিস্তানে ৯ হাজার ৩৯৬, নেপালে ২৫ হাজার ৩৫১, ভুটানে ৭১ হাজার ৩৬৮ এবং মালদ্বীপে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭১ জনের পরীক্ষা হচ্ছে।
শুরু থেকেই জনসংখ্যা অনুপাতে পরীক্ষার দিক থেকে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৫তম। পরীক্ষা কম হওয়ায় কয়েক ধাপ পিছিয়ে এখন বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৪তম।
পাশের দেশ ভারতে গত বৃহস্পতিবার এক দিনে করোনা পরীক্ষা হয়েছে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৪২টি, যা গত এক মাসে বাংলাদেশে হওয়া পরীক্ষার প্রায় দ্বিগুণ। সাত দিন ধরে ভারতে দৈনিক গড়ে পরীক্ষা হচ্ছে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৩৮০টি। আর বাংলাদেশে গত সাত দিনে দৈনিক গড়ে পরীক্ষা হয়েছে ১১ হাজার ১০৫টি। ভারতের জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রায় ৮ গুণ বেশি, কিন্তু দেশটিতে বাংলাদেশের চেয়ে দৈনিক ৪৮ গুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে।
ভারতে জুলাই মাসের শুরু থেকে প্রতিদিন ২০ হাজারের বেশি ব্যক্তির শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে। ১০ দিন ধরে দেশটিতে দৈনিক ৫০ হাজারের বেশি শনাক্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অনেক মিল রয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের সংক্রমণও ঊর্ধ্বমুখীই থাকার কথা।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার দেশে এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, যাতে সংক্রমণ কমতে পারে। সংক্রমণের ভিত্তিতে লাল, সবুজ এলাকা চিহ্নিতের কাজও খুব সীমিতভাবে হয়েছে। তিনি বলেন, পরীক্ষা কম হওয়ায় অনেক রোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভের (দ্বিতীয় ঢেউ) সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদি বৃহত্তর সংক্রমণের দিকেই এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।