এক দশকেও সুরাহা হয়নি ঋণের শর্ত

  • ঋণচুক্তির সময় শর্ত ছিল, ৮৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা ভারত থেকে আমদানি করতে হবে, পরে তা ৭৫ শতাংশ করা হয়।

  • তিন দফায় ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণচুক্তির মধ্যে এখন পর্যন্ত অর্থছাড় হয়েছে ৭০ কোটি ডলার।

ঋণের একটি শর্ত ছাড় দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচনাটা ১ বা ২ বছর নয়, দীর্ঘ ১০ বছরের। কখনো দিল্লি, কখনো ঢাকা; সমস্যা সমাধানে দুই দেশের নীতিনির্ধারকেরা দফায় দফায় বসেছিলেন। দীর্ঘ এক দশকে কর্মকর্তা বদলেছে; কেউ কেউ চাকরি থেকে বিদায়ও নিয়েছেন। কিন্তু সমস্যার সুরাহা হয়নি।

দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে ২০১০ সালে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয় ভারত। সড়ক, রেল, নদীসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ওই টাকা দেওয়া হয়। তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, ঋণচুক্তির সময় শর্ত ছিল, এই ঋণের আওতায় যত প্রকল্প নেওয়া হবে, তা বাস্তবায়নে ৮৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা ভারত থেকে আমদানি করতে হবে।

শুরু থেকেই ঋণের শর্ত নিয়ে আপত্তি ছিল বাংলাদেশের। কারণ, সড়ক, রেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ধরনের উপকরণ ও যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়, তা বাংলাদেশেই সহজলভ্য। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে ঋণের এই শর্তটি শিথিল করার অনুরোধ জানালে ২০১৪ সালে পণ্য ও সেবা আমদানি ৮৫ শতাংশের পরিবর্তে কমিয়ে ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়, নির্মাণকাজের ধরন দেখে কত শতাংশ পণ্য ও সেবা ভারত থেকে আনা হবে, তা প্রকল্প দেখে ঠিক করা হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত এখনো কার্যকর হয়নি।

ভারতের ঋণে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই দেশেরই সমস্যা আছে। দুই দেশের আমলাতন্ত্রই নানা আইন-কানুনের বেড়াজালে চলে। দুই দেশের আমলাতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও রয়েছে। আবার আমরা নিজেরাও অনেক প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন করতে পারি না। আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি আছে, তাদেরও সমস্যা আছে। আমিও চাই ভারতের ঋণে নেওয়া প্রকল্পগুলোর গতি আসুক
এম এ মান্নান, পরিকল্পনামন্ত্রী

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, প্রকল্পের ধরন দেখে কত শতাংশ পণ্য ও সেবা আমদানির যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেটা মানা হচ্ছে না। ৭৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা ভারত থেকেই আমদানি করতে হচ্ছে। তাই যে টাকায় বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্য কেনার সুযোগ ছিল, ভারত থেকে তুলনামূলক বেশি দামে এসব পণ্য কিনতে হচ্ছে। আবার, প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পক্ষেরও সক্ষমতার ঘাটতি আছে। এ নিয়েও বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

২০১০ থেকে এই পর্যন্ত লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ভারতের সঙ্গে মোট তিন দফা ঋণচুক্তি সই হয়েছে। প্রথম দফায় ২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে দ্বিতীয়বার চুক্তি সই হয়; যেখানে আরও ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হয়। সবশেষ ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় সাড়ে ৪০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সব মিলিয়ে ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে ভারত, যে টাকা দিয়ে ৪৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

তিন দফায় ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণে ৪৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তি হয়েছে। তবে শর্ত নিয়ে জটিলতায় বাস্তবায়নে গতি শ্লথ।

আজ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ভার্চ্যুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে ভারতীয় ঋণে নেওয়া প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি স্থান পাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতের ঋণে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই দেশেরই সমস্যা আছে। দুই দেশের আমলাতন্ত্রই নানা আইন-কানুনের বেড়াজালে চলে। দুই দেশের আমলাতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও রয়েছে। আবার আমরা নিজেরাও অনেক প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন করতে পারি না। আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি আছে, তাদেরও সমস্যা আছে। আমিও চাই ভারতের ঋণে নেওয়া প্রকল্পগুলোর গতি আসুক।’

এম এ মান্নান আরও বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন আমাদের নির্মাণসামগ্রীর ঘাটতি ছিল। সেই ঘাটতি এখন নেই। এখন আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। তবে তাদের যেহেতু শর্ত আছে এবং আমরা শর্ত মেনেই চুক্তি করেছি, তাই এটা মানতে হয়। যেহেতু এখন সক্ষমতা বেড়েছে, তাই শর্ত শিথিল করার সুযোগও আছে।’

ভারতের ঋণে নেওয়া প্রকল্পগুলোর ৭৫ শতাংশ সেবা ও মালামাল ভারত থেকে আমদানির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে ন্যূনতম ৫টি ধাপে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। প্রকল্প প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। এসব কারণে ভারতীয় ঋণের নেওয়া প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ভালো নয়
ফাতেমা ইয়াসমিন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব

অগ্রগতি নিয়ে সচিবদের সভা

ভারতের ঋণে নেওয়া প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি কতটা, তা নিয়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ভারতের ঋণে নেওয়া প্রকল্পগুলোর মন্থর গতির পেছনে ঋণের শর্তকে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সভার কার্যবিবরণীতে দেখা গেছে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মহিবুল হক বলেন, সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব নির্মাণসামগ্রী প্রয়োজন, তার মধ্যে রড, সিমেন্ট, বালু বাংলাদেশেই সহজলভ্য। ভারত থেকে এসব পণ্য আমদানি করা হলে তা হবে ব্যয়বহুল। তাতে সময়ও ক্ষেপণ হবে। এ ছাড়া এসব পণ্য আমদানি করা হলে বাংলাদেশ সরকারকে বিপুল অঙ্কের ভ্যাট ও কর দিতে হবে।

ওই সভায় তৎকালীন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব সুলতান আহমেদ বলেছিলেন, পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে বিদ্যুৎ অন্যত্র নেওয়ার জন্য ভারতীয় ঋণে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি ভারতীয় ঋণে না নিয়ে রাষ্ট্রীয় টাকায় বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। তাঁর মতে, ভারতীয় ঠিকাদারের পদ্মা ও যমুনা নদীর মতো বড় নদী পার করে বিদ্যুৎ লাইন নেওয়ার মতো জটিল কাজের অভিজ্ঞতা নেই। এই দেশে পদ্মা সেতু ও যমুনা সেতুর কাজের অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে এবং যাদের প্রয়োজনীয় ক্রেন হ্যামারসহ ভারী যন্ত্রপাতি রয়েছে, তাদের দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করালে দ্রুত শেষ করা সম্ভব হতে পারে।

একই সভায় সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামও ভারতের ঋণের শর্তের কারণে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তাঁর মতে, ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে ভারত থেকে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট পণ্য ও সেবা আমদানি করতে হয়। অথচ ওই সব প্রকল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতি বাংলাদেশেই রয়েছে।

ওই সভায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ফাতেমা ইয়াসমিন বলেন, ভারতের ঋণে নেওয়া প্রকল্পগুলোর ৭৫ শতাংশ সেবা ও মালামাল ভারত থেকে আমদানির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে ন্যূনতম ৫টি ধাপে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। প্রকল্প প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। এসব কারণে ভারতীয় ঋণের নেওয়া প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ভালো নয়।

ভারতীয় ঋণের ব্যবহার

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় ঋণে প্রথম দফায় ২০১০ সালের ১০০ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে ১৪ কোটি ডলার পদ্মা সেতুতে স্থানান্তর করা হয়েছে অনুদান হিসেবে। বাকি ৮৬ কোটি ডলারের আওতায় ১৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১০ বছর আগে। তার মধ্যে ৩টি প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। অর্থ ছাড় হয়েছে ৬১ কোটি ডলার। শতাংশের হিসাবে ৭০ শতাংশ। এখনো শেষ না হওয়া তিন প্রকল্প হচ্ছে: ৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা-মোংলা পোর্ট রেললাইন প্রকল্প, ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনের পুনর্বাসন প্রকল্প এবং ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ।

দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ২০০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি সই হয় ২০১৫ সালে। ওই টাকায় প্রকল্প নেওয়া হয় ১৫টি। তার মধ্যে এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে মাত্র ২টি, যা সরাসরি কেনাকাটা-সংক্রান্ত। যেমন বিআরটিসির জন্য ট্রাক এবং ডাবল ও সিঙ্গেল ডেকার বাস কেনা। এর মধ্যে ২৯০টি দ্বিতল, ৮৮টি একতলা এসি এবং ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস আমদানি করা হয়েছে। ৩৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ভারত থেকে আমদানি করা বাসগুলো নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাসগুলো মানসম্মত না হওয়ার কারণে অধিকাংশ সময় মেরামতের পর্যায়ে থাকে।

সব মিলিয়ে দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় অর্থ ছাড় হয়েছে মাত্র ৮ কোটি ডলার। শতাংশের হিসাবে ৪ শতাংশ। তৃতীয় দফায় ২০১৭ সালে সাড়ে ৪০০ কোটি ডলার ঋণচুক্তির আওতায় প্রকল্প নেওয়া হয় ১৬টি। সাড়ে ৪০০ কোটি ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত অর্থ ছাড় হয়েছে মাত্র ৫১ লাখ ডলার। অর্থাৎ তিন দফায় ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণচুক্তির মধ্যে এখন পর্যন্ত অর্থ ছাড় হয়েছে মাত্র ৭০ কোটি ডলার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের তিন দফায় যে চুক্তি হয়েছে, তা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ চুক্তির শর্ত। প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত থেকে ৬৫ শতাংশ, কোথাও কোথাও ৭৫ শতাংশ পণ্য ও উপকরণ আমদানি করতে হয়। এই শর্ত শিথিল করা যায় কি না, তা নিয়ে দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। কারণ, যেসব পণ্য ও উপকরণ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়, সেসব পণ্য ও উপকরণ আমাদের দেশেই সহজলভ্য।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘ভারতের ঋণে নেওয়া প্রকল্পে দুই পক্ষেরই সমস্যা আছে। ভারতের এক্সিম ব্যাংক কাগজপত্রের প্রক্রিয়া করতে বেশ সময় নেয়, অন্যদিকে আমাদেরও প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার ঘাটতি আছে। প্রকল্প প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত আমাদের সমস্যা আছে। সব মিলিয়েই দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। প্রকল্প থেকে যে ফলাফল পেতে পারতাম, সেটাও পাচ্ছি না। আমি মনে করি আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করা সম্ভব, শর্ত শিথিল করা সম্ভব। এটা হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসবে।’