১ হাজার ২৫৬ জনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে যে নতুন তালিকা করা হয়েছে, তাতে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তালিকা যাচাই-বাছাই করেই ৩০ জন অমুক্তিযোদ্ধা পেয়েছে সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি। অন্য জেলার তালিকা যাচাই-বাছাই করা হলে আরও অমুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এই অনিয়মের জন্য মূলত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়েছে। উপজেলা থেকে যাচাই-বাছাই হয়ে তালিকা আসার পর জামুকার কর্মকর্তারা এসব নাম তালিকায় যুক্ত করেছেন। এ ঘটনায় জামুকার সহকারী উপপরিচালক আবদুল খালেককে গত বৃহস্পতিবার বরখাস্ত করা হয়েছে।
‘মুক্তিযোদ্ধার নতুন তালিকায়ও বিতর্কিতরা’ শিরোনামে গত ৭ জুন প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনকে বিবেচনায় নিয়ে মাত্র একটি জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার বিষয়ে তদন্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুস সামাদ তদন্ত কমিটির প্রধান। কমিটি তাদের প্রতিবেদন জামুকাতে পাঠিয়েছে। তদন্ত কমিটির একজন সদস্য বলেন, প্রথমে একটি জেলার তালিকা যাচাই করা হলো। পর্যায়ক্রমে অন্য জেলা-উপজেলার তালিকাও যাচাই করার কথা রয়েছে।
তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসার বিষয়টি স্বীকার করে জামুকার মহাপরিচালক জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি খুব দুঃখজনক। উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি ও বিভাগীয় কমিটির যাচাই-বাছাই শেষে জামুকার সভায় এই তালিকা অনুমোদন করা হয়। তারপরও এত অনিয়ম। এ ব্যাপারে জামুকার পরবর্তী বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী তাৎক্ষণিক একজন পরিচালককে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
>নতুন মুক্তিযোদ্ধা তালিকা
তদন্ত কমিটি পর্যায়ক্রমে অন্য জেলা-উপজেলার তালিকাও যাচাই করতে চায়
তদন্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মির্জা ইসমত ইনুনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া ও জাল প্রমাণিত হয়েছে। কমিটি বলেছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাল ও ভুয়া চিঠি তৈরি করে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংসদের অনুলিপি ব্যবহার করে মির্জা ইনুনকে সাক্ষাৎকার বোর্ডে উপস্থিত দেখানো হয় এবং জামুকার ৬৬তম সভায় তাঁর নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রকাশের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। কমিটি বলেছে, ইউএনও অফিস থেকে এই প্রতিবেদন পেয়েছেন তাঁরা। জামুকা পরীক্ষা করলেই জাল হিসেবে শনাক্ত হতো।
একইভাবে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি গ তালিকা (বাদ তালিকা) থেকে বাদ দিয়ে ক তালিকা (সঠিক কাগজপত্র যাঁদের আছে) তালিকায় প্রতিস্থাপন করে। এ ছাড়া বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সুপারিশ করা ১০ জনকে, আখাউড়ার একজনকে, কসবা উপজেলার ৪ জনকে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ৫ জনকে সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার তিনজন বিভাগীয় পুনর্যাচাই কমিটির সাক্ষাৎকারে অনুপস্থিত ছিলেন। জেনেবুঝে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ধরনের অনিয়ম করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মির্জা ইসমত ও আওলাত হোসেনকে অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে যাচাই-বাছাইয়ের সময় তাঁদের নাম বাতিল তালিকায় রেখেছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের একজন এখন মৃত। অথচ ৩ জুন এই দুজনকে যুক্ত করে নতুন করে ১ হাজার ২৫৬ জনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও দেশের যে কয়টি জেলার নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তার অনেকগুলো নিয়েই বিতর্ক আছে।
তালিকা প্রকাশের সময় অবশ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘জেলা-উপজেলা থেকে যেসব প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, আমরা তা যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করেই নতুন তালিকা প্রকাশ করেছি।’
এর আগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকা প্রকাশ—প্রথম পর্ব’ শিরোনামে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে সারা দেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে ওই তালিকা স্থগিত করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর জামুকার ৬৬তম সভায় নতুন প্রায় ১ হাজার ৩০০ মুক্তিযোদ্ধার নামের একটি তালিকা অনুমোদন করা হয়। গেজেট প্রকাশের আগে যাঁরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে পারেননি, তাঁদের নাম বাদ দিয়ে ১ হাজার ২৫৬ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়।