ভাষা আন্দোলনের ঘটনাধারা-১০

একুশের সন্ধ্যারাতটা শাসকদের জন্য ছিল কালবেলার মতো

একুশে ফেব্রুয়ারি
ফাইল ছবি

একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যারাতের সময়টা শাসকদের জন্য বোধ করি কালবেলার মতো হয়ে ওঠে। যেমন পরিবেশে, তেমনি ঘটনার তাৎপর্যে। তখন মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে ছুটে আশা মানুষের পায়ে পায়ে ওঠা ধুলো আর কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়াটে গন্ধের অবশিষ্ট মিলে এক অভাবিত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ছাত্র-জনতার শোক ও কান্না শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে এক ধরনের ঘৃণা ও শক্তির জন্ম দেয়, যা আন্দোলনের জন্য হয়ে ওঠে বিস্ফোরক পঁুজি। সে পঁুজির সদ্ব্যবহারে পরদিন এগিয়ে আসে ঢাকাই ছাত্র-যুবা-জনতার আবেগ, যা মিছিলে, স্লোগানে ও তৎপরতায় প্রকাশ পায়।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় এবং পরদিন আমতলার ছাত্রসভায় যেসব ছাত্র-যুবা ও রাজনৈতিক নেতা ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাঙার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তাদেরই কেউ কেউ একুশের কালসন্ধ্যায় চোখের জলে ভিজে শহীদদের প্রতি সমবেদনা জানাতে এসেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ‘হঠকারী পদক্ষেপ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। বিলুপ্ত সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব একই মানসিকতায় ২২ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিসংবলিত ইশতেহারের খসড়ায় স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করেন (আবদুল মতিন)।

কিন্তু রক্ত ঝরানো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে উদ্দীপনার জন্ম, তার টানে সেদিন এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় যা একুশের আন্দোলনকে জনসমর্থনে শক্তিমান করে তোলে। সংগ্রাম পরিষদেরই সিদ্ধান্তমতো পরিস্থিতির বিচারে পরিষদ বিলুপ্ত হওয়ার কথা। তাই মেডিকেল কলেজ ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মাওলার কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তাঁকেই সংগ্রাম পরিষদের অস্থায়ী আহ্বায়ক মনোনীত করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির।

সেসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদদের নিয়ে হোস্টেল প্রাঙ্গণে জানাজা অনুষ্ঠান ও শোকসভা, তাঁদের লাশ ও রক্তমাখা কাপড়ের পতাকা নিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল, বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা তোলা এবং শোকচিহ্ন হিসেবে প্রত্যেকের বুকে বা বাহুতে কালো ব্যাজ ধারণ। জনমানসে উদ্দীপনা জোগাতে এবং আন্দোলনের সঙ্গে জনচেতনাকে একাত্ম করে তুলতে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।  ইনসাফ  ও  আজাদ  পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য একই কথা বলে।

ভাষা আন্দোলন, আহমদ রফিক

এদিকে মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি হলের পেছনের ঠান্ডা বারান্দায় আলো-আঁধারে রক্তাক্ত রফিকউদ্দিন শয়ান। অন্যদিকে হাসপাতালের দোতলায় এক কক্ষে আবদুল জব্বারের নিথর প্রাণহীন দেহ। আত্মদানেও বুঝি তাদের ভাষিক দায় শেষ হয়নি।

আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রদের প্রবল ইচ্ছা, তারা মিছিলে ছাত্র-জনতার সঙ্গী হন। সে উদ্দেশ্য নিয়েই পরদিনের কর্মসূচি, যাতে ঘাতকদের কর্মকাণ্ডের পাল্টা জবাব দেওয়া যায়। জনতার কাঠগড়ায় তাদের যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করা যায়।

জানাজা, শোকসভা ও মিছিলের সিদ্ধান্ত ছাড়াও সেদিন সন্ধ্যারাতের তৎপরতায় ছিল ওই সময়ের মধ্যেই প্রতিবাদী কর্মসূচিসংবলিত ইশতেহার ছেপে প্রতিটি ছাত্রাবাসে বিতরণ এবং গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রাবাস ও সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। এককথায় একটি সফল আন্দোলনের জন্য কাঠখড় পোড়ানো। এ কাজটা ছাত্র-যুব নেতৃত্ব ঠিকঠাকমতোই করেছিল, যদিও পুলিশের হাত থেকে রফিক-জব্বারের লাশ রক্ষা করতে পারেনি।

কিন্তু গুলিবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনার ব্যাপক ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সরকারবিরোধী মনোভাব সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর চতুর প্রশাসনের চেতনায় অশুভ সংকেত ছড়িয়ে দিয়েছিল। মেডিকেল ব্যারাকের কন্ট্রোল রুম থেকে মিছিল-কর্মসূচির বিরতিহীন প্রচার যেমন জনমানসে ক্রমাগত ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছিল, তেমনি সতর্ক করে দিয়ে থাকবে চতুর আমলাতন্ত্রকে। তাই ছাত্রদের চোখ এড়িয়ে গভীর রাতে রফিক-জব্বারের লাশ গুম করে ফেলে পুলিশ। দুপুরে এরাই তুলে নিয়েছিল ফুলার রোড থেকে গুলিবিদ্ধ এক কিশোরকে।

সেদিনই গভীর রাতে বিবেকহীন সরকারের প্রতিনিধিদের উদ্যোগে ওই শহীদদের শেষ আশ্রয় জোটে আজিমপুর কবরস্থানের গণকবরে, তাঁদের স্বাভাবিক দাফনের সব দাবি অগ্রাহ্য করে। মৌলভি গফুর ও ড্রেসার সুরুজ্জামানের সাক্ষ্যে ওই সত্য বেরিয়ে আসে। আর ২২ ফেব্রুয়ারি খুব ভোরে মেডিকেল কলেজের দুই তরুণ ছাত্র আলমগীর ও আমির আহসান ওই কবরের ওপর থেকে রক্তমাখা কিছু কাপড়চোপড়ের অংশ নিয়ে এসে সেই অপকর্মের হদিস জানায়।

লাশ গুম করেও তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি সরকার। সন্ধ্যারাতের শিখা জনমনে ঠিকই আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। ছাত্রদের নেওয়া কর্মসূচির তীব্র প্রভাব যে সরকারের জন্য এক অশুভ সংকটকাল তৈরি করেছিল, ২২ ফেব্রুয়ারির গণ-আন্দোলন তার প্রমাণ। আর সে আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যায় ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা। দিন কয়েকের জন্য ছাত্র এলাকা মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। তাই ঢাকার ডিএসপি সিদ্দিক দেওয়ানের ক্ষুব্ধ মন্তব্য: ‘দ্যাশ তো এখন আপনারাই চালাচ্ছেন।’


সূত্র: ভাষা আন্দোলন, আহমদ রফিক, প্রথমা প্রকাশন, ২০০৯