নাম এছেম আলী হলেও পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের কাছে তিনি ছিলেন ‘জল্লাদ’। যাঁর কাছে কোনো ক্ষমা নেই। হুকুম হলেই খতম। সাহসীকতার কারণে একাত্তর সালে সহযোদ্ধারা অনেকেই তাঁকে এ নামে ডাকতেন। সেই থেকে ‘জল্লাদ’ নামেই পরিচিত। বলছিলাম কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলা শহরের একাত্তরের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এছেম আলীর কথা। মুক্তিযুদ্ধের পর সবাই তাঁকে ‘জল্লাদ’ নামেই চেনেন।
২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিলের দুপুরে কথা হলো এছেম আলীর পরিবার ও দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে। কথার ফাঁকে বড় ছেলে ইছহাক আলী জানালেন, বাবা মারা গেছেন ২০০৯ সালের ১৮ জুলাই। স্মৃতি হিসেবে আছে বাবার ডায়েরি, একখানা ছবি আর কিছু কাগজপত্র। পুরাতন বাক্স থেকে সেগুলো বের করে আমার হাতে দিলেন। ডায়েরির পাতায় পাতায় খুঁজে পাওয়া গেল এই মুক্তিযোদ্ধার অপ্রকাশিত, অজানা, আড়ালে থাকা দুষ্প্রাপ্য তথ্য। মুক্তিযুদ্ধসহ জীবনের নানা স্মৃতিময় ঘটনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন তিনি তাঁর ডায়েরিতে।
বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতিময় ডায়েরি আমাকে দিলেন ইছহাক আলী। নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে বললেন, তাঁর বাবার ইতিহাস। বেশি করে লিখতে বললেন। এটাও জানালেন, তাঁর বাবা অসুস্থ থাকার সময় মুখে বলতেন আর বাবার বন্ধু কানু দাশ ডায়েরিতে তা লিখতেন। কানু দাশ ছিলেন এছেম আলীর সহযোদ্ধা ও পারিবারিক বন্ধু।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এছেম আলী তাঁর দিনলিপিতে উল্লেখ করেছেন ১৯৩২ সালের ৩ মার্চ কুষ্টিয়া জেলার হরিনারায়পুরের মিরপুর গ্রামে জন্ম। ১৯৭৩ সালে পরিবার নিয়ে খোকসা চলে আসেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খোকসাতেই ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আনসারের চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনস ও হার্ডিং ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণে ভালো দক্ষতার কারণে আনসারের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। সীমান্তবর্তী প্রাগুপুর চতুর্থ উইং কমান্ড ইপিআরদের সহযোগিতায় তাঁকেসহ ১৪ জনকে পাকিস্তান সরকার ভারত মিশনে পাঠায়। সাহসিকতা ও দক্ষতার কারণে মেজর মহম্মদ আলী তাঁকে ভূয়সী প্রশংসা করে সনদ দিয়েছিলেন। পাক–ভারত যুদ্ধ শেষে পুনরায় কুষ্টিয়ায় কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রতিবাদ করায় ৪২ দিন কারাভোগ করেন। জেলখানায় তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। অবশেষে ১৯৭১ সালে চাকরি ছেড়ে অস্ত্র নিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এছেম আলী। তিনিসহ সহযোদ্ধারা মিলে কুষ্টিয়ায় তৈরি করেন ‘কুষ্টিয়া রক্ষাবাহিনী’। থানা ও বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। তারপর কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ, মাগুরার শ্রীপুর, রাজবাড়ীর পাংশা এলাকায় প্রায় তিন শ মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ ও বাহিনী গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
ডায়েরির পাতায় পাতায় রয়েছে যুদ্ধদিনের ঘটে যাওয়া নানা স্মৃতিময় কথা। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক এমপি মরহুম গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে ছিল এছেম আলীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁর লেখা পত্র নিয়ে চলে যান ভারতে। সেখানে ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাতের পর এলএমজি-২ অস্ত্রের অনুমতির পর সাক্ষাৎ করেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) সঙ্গে। অস্ত্রের অনুমতি, প্রশিক্ষণ ও সাহসিকতার কারণে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাঁকে নথিভুক্ত করে সঙ্গে রেখে দেন যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত। বিভিন্ন যুদ্ধে সরাসরি তিনি অসংখ্য রাজাকার, পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের হত্যা ও আটক করেছেন। আবার হারিয়েছেনও অনেক সহযোদ্ধাকেও।
ডাঁশার চাষি ক্লাব যুদ্ধ, কুষ্টিয়া ওয়ারলেস গেট, বংশীতলা ও করিমপুর, যুদ্ধসহ একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এছেম আলী। একটি যুদ্ধে তিনি যুদ্ধাহত হন। লুৎফর কমান্ডার, ফুল কমান্ডার, আব্দুল মালেক, লাহরী খাঁ, ওমর আলী ছিলেন তাঁর সহযোদ্ধা।
ডায়েরির শেষাংশে এছেম আলী উল্লেখ করেছেন, ‘আমার আকুল আবেদন বাংলার মানুষের কাছে, হোক বা না হোক ইতিহাসের পাতায় আমার নাম, তাতে উৎসাহ নেই। আমার একান্ত ইচ্ছে, যারা জানে তারা ভাববে। আর অজানাদের জন্য রেখে গেলাম এ ক্ষুদ্র অথচ সত্য বাস্তব ইতিহাস। আগামী প্রজন্মের কাছে রেখে গেলাম আমার এ রচনা। যদি কিছু পাও শিক্ষার কণা এতে রচিও অমর বর্ণনা।’
দেশ স্বাধীনের পর এছেম আলী বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ খোকসা উপজেলা শাখার ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্বেও ছিলেন দীর্ঘদিন। পরপর দুবার ছিলেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সংসার জীবনে রেখে গেছেন স্ত্রী, চার ছেলে, চার মেয়ে।
জ্যেষ্ঠ ছেলে ইছাহাক আলী জানালেন, বাবা ছিলেন কুষ্টিয়ার নামকরা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সর্ম্পক আছে এমন কেউ নেই যে বাবাকে চেনেন না। সাহসিকতার কারণে বাবাকে সবাই ‘জল্লাদ’ বলে ডাকতেন।
খোকসা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক জানালেন, এছেম আলী আমার সহযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান কোনোভাবেই ভোলার নয়।
ডায়েরির লেখক কানু দাশ জানালেন, আমি ছিলাম মুদ্রাকর। তিনি বলতেন, আমি লিখতাম। তা–ও প্রায় ২০ বছর আগের কথা। আমি ছিলাম তাঁর ধন্য ও বিশ্বাসী মানুষ।
এছেম আলীর গেজেট নম্বর ১৩৯৬। প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সনদ নম্বর ২৮৮৮৬। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সনদ নম্বর-প্র-৩/৫৪/২০০২/৬০৩।
* ইমাম মেহেদী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক এবং মুক্তিযুদ্ধের গবেষক কুষ্টিয়া। ই–মেইল: emam.mehedi@gmail.com