মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকার যুবক আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, চার ছেলের একজনকে দেশের জন্য দিতে পারবে না? সন্তানের প্রশ্নে নিরুত্তর ছিলেন মা। সমরযুদ্ধে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জে ২০ নভেম্বর প্রাণ দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের তরুণ, যুবকদের হাসিমুখে প্রাণ দেওয়ার এমন অসংখ্য গল্প নিয়ে গাঁথা মহান স্বাধীনতা। একাত্তরের সেই যুবকেরা এখন বর্ষীয়ান। রাইফেল হাতে নিজের প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করা সেই যুবকদের কারও কারও এখন চলাফেরা করতে লাঠির প্রয়োজন হয়। সেই বীরযোদ্ধারা শনিবার বিকেলে একসঙ্গে উঠে এসেছিলেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মঞ্চে।
বীরসেনাদের অভিজ্ঞতা নিয়েই বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে ওয়ারকোর্স বাংলাদেশের প্রথম স্মারকগ্রন্থ ‘মূর্তির ৬১: মুক্তির ৭১’ এবং ‘দ্য মূর্তি বয়েজ’। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সৈয়দ মুনিবুর রহমানের স্বাগত বক্তব্যের পর রণাঙ্গনের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। আয়োজনে ভারত থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আর পি সিং পিভিসিএম। ’৭১ সালে মূর্তি ক্যাম্পের তরুণ প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি। বলছিলেন, প্রশিক্ষণের সময় খাবার, পোশাক, ঘুমানোর জায়গা সব কিছুরই অভাব ছিল কিন্তু কখনোই কিছু নিয়ে অভিযোগ শোনা যায়নি তরুণ যোদ্ধাদের কাছ থেকে। তাঁরা হাসিমুখে দেশের জন্য যেন নিজেকে উৎসর্গ করতেই এই পথ বেছে নিয়েছিলেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে মূর্তি নামের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ৬১ জন যুবক। বিভিন্ন সেক্টরে দক্ষ সামরিক কর্মকর্তা তৈরি করতে ভারতে অবস্থানকারী বাঙালি তরুণদের বাছাই করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে। তাঁদেরই অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকাশিত হলো এই গ্রন্থ। চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল বললেন, স্মৃতির বিশাল শক্তি আছে। সে শক্তি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সঠিকভাবে তুলে ধরা না হলে সত্য ইতিহাসটা অজানা রয়ে যায়।
মূর্তি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া ৬১ জন শুধু সংখ্যা নয়। তাঁরা বাংলাদেশের প্রতিভূ বলে মন্তব্য করেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যেকোনো ইতিহাসকেই সঠিক মূল্যায়ন না করলে এর ফাঁকফোকরে জঞ্জাল প্রবেশ করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই সংগ্রামের ইতিহাসের জঞ্জাল দূর করতে পারে এই গ্রন্থের মতো একটি প্রামাণ্য দলিল।’ এ বইয়ের তথ্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন তিনি।
‘দ্য মূর্তি বয়েজ’ বইয়ের বাংলা সংস্করণ ‘মূর্তির ৬১: মুক্তির ৭১’ প্রকাশ করেছে সাহিত্যপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি এবং সাহিত্যপ্রকাশের কর্ণধার মফিদুল হক বলেন, প্রতিরোধ বাঙালির বড় সম্পদ। সেই প্রতিরোধের ইতিহাসসহ মুক্তিযুদ্ধের নানা মাত্রা উঠে এসেছে বইয়ে।
দ্য মূর্তি বয়েজ প্রকাশ করেছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন জানান, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাত্রা করে অবশেষে বই প্রকাশ হয়েছে। সম্পাদনা, সংকলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বইটি আরও বেশি সমৃদ্ধ।
বিশাল মুক্তিযুদ্ধ কোনো দিন পরিমাপ সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম। ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি ‘মূর্তির ৬১: মুক্তির ৭১’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৬১ জনের অনেকেই এই বীর উত্তমের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন। তিনি বললেন, শুধু যোদ্ধাদের ইতিহাস নয়, তুলে ধরতে হবে দেশের সাধারণ মানুষের অবদানও। তাদের সমর্থন না থাকলে আরও অনেক বেশি প্রাণহানি হতো। ‘মূর্তির ৬১: মুক্তির ৭১’ বইটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ইশরাত ফিরদাওসী। সম্পাদনা, তথ্য সমন্বয় ও অনুবাদের দায়িত্বে ছিলেন কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা ও তানিম আহমেদ।
মোড়ক উন্মোচনের পর উপস্থিত মূর্তি বয়েজের সেই বীরযোদ্ধারা মঞ্চে উঠে বই দুটি তুলে ধরেন। পরমুহূর্তেই তাঁরা শুরু করেন রণাঙ্গনে নিজেদের ফেলে আসা সময়ের গল্প। বর্ষীয়ান এই মানুষগুলো যেন আবারও হয়ে ওঠেন ৫০ বছর আগের সেই অদম্য যুবক।