ভারতে পাচার হওয়া এক কিশোরী সম্প্রতি দেশে ফিরে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেছেন। এরপর ওই মামলায় তিনজনকে গতকাল মঙ্গলবার সাতক্ষীরা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে মেহেদি হাসান বাবু (৩৫) মামলার বাদী ওই কিশোরীসহ এক হাজারের বেশি নারীকে ভারতে পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ।
আজ বুধবার শ্যামলীতে নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান মো. শহিদুল্লাহ।
গ্রেপ্তার অপর দুই আসামী মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদের মামলার বাদী ভুক্তভোগীসহ পাঁচ শতাধিক নারীকে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি কক্ষে রাখতে সহায়তা করেছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ভুক্তভোগী নারীদের মোটরসাইকেলের মাধ্যমে সীমান্তে মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন গ্রেপ্তার হওয়া ওই দুই ব্যক্তি।
সম্প্রতি বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর ভারতে নারী পাচার হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। ভারতে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের সে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে হাতিরঝিল থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মানব পাচার ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করেছেন তরুণীটির বাবা। তিনি মামলায় বলেছেন, তাঁর মেয়েকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর কথা বলে ভারতে নিয়ে যান রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয় (২৬)।
সেই আলোচিত ঘটনার পর এবার আরেকজন কিশোরী পালিয়ে এসে নিজেই হাতিরঝিল থানায় মামলাটি করেছেন। ২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলাটি করা হয়। গতকাল রাত সাড়ে ১০টায় সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে ভুক্তভোগীকে ভারতে পাচারের সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে নারী পাচারের কাজে ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল, একটি ডায়েরি, চারটি মুঠোফোন ও একটি ভারতীয় সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
এ মামলার ১২ আসামীর মধ্যে গ্রেপ্তার তিনজনসহ মোট পাঁচজন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন বলে প্রাথমিকভাবে জেনেছে পুলিশ। বাকিরা ভারত থেকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। বাংলাদেশের পাঁচজনের মধ্যে গ্রেপ্তার তিন আসামীর সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওতে অভিযুক্ত রিফাদুল ইসলামের যোগসাজশ পেয়েছে পুলিশ।
গতকাল গ্রেপ্তার হওয়া মেহেদি হাসানের (৩৫) বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের ডিসি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘সে প্রায় সাত থেকে আট বছর ধরে মানব পাচারে জড়িত। তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা মুঠোফোন ও ডায়েরিতে হৃদয় বাবু, সাগর, সবুজ, ডালিম ও রুবেলের ভারতীয় মুঠোফোন নম্বর পাওয়া গেছে। পাশাপাশি তাঁর কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ডায়েরিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ঘটনার ভুক্তভোগীর “আধার নম্বর” ও ভারতে পাচারকৃত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভুক্তভোগীর নাম ও মানব পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।’
ডিসি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, পাচার হওয়া ভুক্তভোগীর সঙ্গে আসামী টিকটক হৃদয়ের পরিচয় ২০১৯ সালে হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে। টিকটক ‘তারকা’ বানাতে চেয়ে বা ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তরুণীটিকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে হৃদয় বাবু।
এরপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০ থেকে ৮০ জনকে নিয়ে ‘টিকটক হ্যাংআউট’ করেন হৃদয়। এরপর একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০ থেকে ৮০০ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে ‘পুল পার্টির’ আয়োজন করে হৃদয়।
অবশেষে ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহের মাজারে আয়োজিত টিকটক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় এ মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে বলে জানিয়েছেন তেঁজগাওয়ের উপকমিশনার।
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ভারতে পাচারের পর ভুক্তভোগীকে বেঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় কয়েকটি বাসায় পর্যায়ক্রমে রাখা হয়। পালিয়ে আসা তরুণীটি এ চক্র কর্তৃক পাচার করা আরও কয়েকজন বাংলাদেশি ভুক্তভোগীকে সেখানে দেখতে পান। তাঁদের সুপারমার্কেট, সুপারশপ ও বিউটি পারলারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে।
মো. শহিদুল্লাহ আরও জানান, বেঙ্গালুরুতে পৌঁছার কয়েক দিন পরই ভুক্তভোগীকে চেন্নাইয়ের ওওয়াইও হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতনের পর সামান্য দয়া ও করুণাও দেখাননি এ চক্রের সদস্যরা। বরং কৌশলে নেশাদ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিবস্ত্র অবস্থার ভিডিও ধারণ করে পরিবারের সদস্য ও পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে তা পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয় ভুক্তভোগীকে।
অবশেষে ভারতে পাচারের ৭৭ দিন পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ঘটনার ভুক্তভোগীর সহযোগীতায় আস্তানা থেকে এ তরুণী পালিয়ে আসেন বলে জানিয়েছেন ডিসি মো. শহিদুল্লাহ।
এই তরুণীর সঙ্গে আর কোনো কিশোরী পালাতে পেরেছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি পালিয়ে আসা কিশোরীদের সংখ্যা জানার জন্য। তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারলে এবং যোগাযোগ পুরোপুরি স্থাপন করতে পারলে আপনাদের জানাব।’
পাচার হওয়ার পর কোনো নিখোঁজ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে মো. শহিদুল্লাহ বলেন, প্রথম দিকে তাঁরা গোপন রাখেন বিষয়টা। আত্মীয়স্বজনের বাসায় খোঁজখবর নেন যে অন্য কোথাও গেছেন কি না। পরিবার বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করে বিষয়গুলো গোপন রাখে। তাঁদের স্বজনেরা অভিযোগ করেননি। মেয়েটি ফিরে এসে অভিযোগ করেছেন।
পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও জানান ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে তাঁরা ‘আনঅফিশিয়ালি’ যোগাযোগ করছেন।
মো. শহিদুল্লাহ আরও বলেন, ‘টিকটক দেশে জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে উঠতি বয়সী মেয়েদের স্টার হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এ কাজে নিয়ে যান। টিকটকের মাধ্যমে এ মেয়েগুলোর পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য টিকটককে আমরা নেগেটিভলি দেখছি। নিম্নবিত্তের বখে যাওয়া ছেলেমেয়েরাই এখানে যুক্ত হচ্ছে।’
আসামীদের ভারতে যাওয়ার কোনো বৈধ কাগজপত্র পাওয়া গেছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে ডিসি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘তাঁদের বৈধ কাগজপত্র পাইনি। কাগজ বা পাসপোর্ট কোনোটাই পাইনি। তাঁরাও ওখানে গিয়ে ‘আধার কার্ড’ নামে একটা কার্ড করে এর মাধ্যমে তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় মুভমেন্ট করেছেন। আমরা তদন্ত করে দেখছি, তাঁরা কীভাবে সীমান্ত পার হয়ে গেলেন।’
এদিকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত সোমবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। ঝিনাইদহ, যশোর ও বেনাপোলে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে। একজন হলেন টিকটক ভিডিও বাংলাদেশ চক্রের প্রধান আশরাফুল মণ্ডল ওরফে রাফি ও তাঁর সহযোগী শাহিদা বেগম। র্যাব জানিয়েছে, গ্রেপ্তার রাফি টিকটক হৃদয়ের বস।
পুলিশ আগে প্রথম আলোকে জানিয়েছিল, রিফাদুল টিকটক ভিডিও বানানোর ফাঁদে ফেলে আরও কয়েকজন তরুণীকে ভারতে পাচার করেছেন বলে তারা তথ্য পেয়েছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা রিফাদুল ঢাকার উত্তরা, খিলগাঁও ও হাতিরঝিলে মেয়েদের নিয়ে টিকটক ভিডিও তৈরি করতেন। বাসার কাছের হাতিরঝিলেই ভিডিও বানাতেন বেশি। এভাবে মেয়েদের ফাঁদে ফেলে মানব পাচারকারী চক্রের যোগসাজশে ভারতে পাচার করতেন। প্রাথমিকভাবে ঢাকার কয়েকজন তরুণীকে ভারতে পাচার করার তথ্য পেয়েছে পুলিশ।