>২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা হয়। জঙ্গিরা হত্যা করেছিলেন ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে। ভয়াবহ এই হামলার ঘটনা স্তম্ভিত করেছিল পুরো বাংলাদেশকে।
ঘটনায় জড়িত: আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শ অনুসরণকারী গোষ্ঠী নব্য জেএমবি।
প্রধান সমন্বয়কারী তামিম চৌধুরী: ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ ভাগে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া বাজার এলাকার কলেজ মোড়ের একটি বাসায় ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় হামলার পরিকল্পনা। পরিকল্পনাকারী ও প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী। তিনি ২০১৩ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে আসেন। পূর্বপুরুষের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারের বড়গ্রামে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে কানাডা চলে যান।
হোলি আর্টিজানে হামলা কেন: জঙ্গিদের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য। কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্য জানান দেওয়া, বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানো, দেশে–বিদেশে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা
হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি: রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, সামেহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল।
প্রস্তুতি: ২০১৬ সালের মার্চে তামিম চৌধুরী ও শরিফুল ইসলাম খালেদ কল্যাণপুরে আসামি আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশের ভাড়া বাসায় ওঠেন। তামিম আহমেদ চৌধুরী রমজান মাসেই কূটনৈতিক পাড়ায় বড় ধরনের হামলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। আসলাম ও শরিফুল সায় দেন। ওই বছরের মে মাসে শুরা সদস্য হিসেবে যুক্ত হন আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ। তামিম চৌধুরী, বাশারুজ্জামান, সোহেল মাহফুজ ও অন্যরা হামলার পরিকল্পনা এগিয়ে নেন। সোহেল মাহফুজকে লোক, অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নুরুল ইসলাম মারজান ও হাদিসুর রহমান সাগরও।
হামলাকারী নির্বাচন: শরিফুল ইসলাম খালেদ আত্মঘাতী হামলার জন্য দুজন সদস্য চান জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীর কাছে। রাজীব গান্ধী দুজনকে পাঠান। তাঁরা হলেন শরিফুল ইসলাম (শোলাকিয়ায় হামলাকারী) ও খায়রুল ইসলাম পায়েলকে পাঠান। শরিফুলের জিম্মায় ছিলেন আরও চারজন। তাঁরা হলেন রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল, নিবরাস ইসলাম ও সামেহ মোবাশ্বের।
আবাসিক প্রশিক্ষণ: সন্ত্রাসবাদ বিস্তারে সহায়ক এমন অডিও, ভিডিও ও প্রবন্ধ অনুবাদ করে উদ্বুদ্ধ করা ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে হাতে–কলমে শেখানো এবং থ্রিমা, উইকার, সিকিউর চ্যাটের মতো অ্যাপ ব্যবহারে পারদর্শী করে তোলা ছিল এই প্রশিক্ষণের বিষয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে, আইইডি (হাতে তৈরি গ্রেনেড), চাপাতি ও ছোট অস্ত্র ব্যবহারে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ।
আবাসিক প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন রাকিবুল হাসান (রিগ্যান) ও নুরুল ইসলাম (মারজান)। তামিম আহমেদ চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, মারজান, শরিফুল ইসলাম খালেদ, মামুনুর রশিদ রিপন, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী দায়িত্ব ছিল উদ্বুদ্ধ করা।
সশস্ত্র প্রশিক্ষণ: মে মাসের (২০১৬) প্রথম সপ্তাহে গাইবান্ধার সাঘাটা যমুনা নদীর চর ফুলছড়িতে প্রশিক্ষণ। দায়িত্বে ছিলেন রায়হানুল কবির রায়হান, মেজর (অব.) জাহিদ। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ও ঝিনাইদহে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চূড়ান্ত হামলার জন্য প্রস্তুত করা।
অর্থায়ন: ভারত থেকে হুন্ডির মাধ্যমে আসে ১৮ লাখ টাকা। তানভীর কাদেরির গাড়ি বিক্রির ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশের ৪০-৫০ হাজার টাকা দেন। এর বাইরেও বিভিন্ন জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠনের সদস্যরা নিজ অঞ্চল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তহবিলে জমা করেন।
অস্ত্র সংগ্রহ: আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ ২০১৬ সালের মে মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চারটি নাইন এমএম পিস্তল, আটটি ম্যাগাজিন ও ৩৫ রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করেন। বাশারুজ্জামানের মাধ্যমে কল্যাণপুরে পৌঁছান।
মামুনুর রশিদ রিপন ৩-৪টি একে ২২ রাইফেল, নুরুল ইসলাম মারজান ভারতে অবস্থানরত ছোট মিজানের কাছ থেকে ৩-৪টি ছোট অস্ত্র, গুলি এবং বিস্ফোরক, সারেয়ার জাহান মানিক একটি একে ২২, রাইফেল ও ২২ রাউন্ড গুলি সাতক্ষীরায় রেখে যান। হামলার ২০-২২ দিন আগে হাদিসুর রহমান সাগর হানিফ পরিবহনের বাসে করে যশোর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এর কয়েক দিন পর ঝিনাইদহ থেকে চারটি গ্রেনেডও আনেন হাদিসুর।
চূড়ান্ত প্রস্তুতি: প্রশিক্ষণ শেষে বসুন্ধরায় তানভীর কাদেরির ভাড়া বাসায় ওঠেন পাঁচ হামলাকারী। বিদেশি নাগরিকদের হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে জুন মাসের শেষার্ধে আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ প্রথমে গুলশান পার্ক ও হোলি আর্টিজান বেকারি রেকি করেন। পরবর্তী তিন দিন হামলাকারীদের নিয়ে বাশারুজ্জামান চকলেট, রাজীব গান্ধী ও আসলাম হোসেন হোলি আর্টিজান বেকারি, যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা পার্ক, বনানী কফি শপ রেকি করে। হোলি আর্টিজান বেকারিকে হামলার জন্য বেছে নেওয়া হয় ৩০ জুন।
১ জুলাই: সকাল ১০টায় বাশারুজ্জামান চকলেট রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম ও মীর সামেহ মোবাশ্বেরের ব্যাগে তিনটি একে-২২ রাইফেল, তিনটি পিস্তল, তিনটি বড় চাকু, তিনটি গ্রেনেড ও পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্রের গুলি ও বিস্ফোরক দেন।
নুরুল ইসলাম মারজান পিস্তল, চাকু ঢুকিয়ে দেন খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বলের ব্যাগে। বিকেল ৫টায় রোহান, নিবরাস ও মোবাশ্বের ও সাড়ে ৫টার দিকে শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল হোলি আর্টিজানের উদ্দেশে বের হন। রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁরা হানা দেন হোলি আর্টিজানে।
সূত্র: অভিযোগপত্র ও আসামিদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তৈরি।