একদিকে অপচয়, অন্যদিকে ঝুঁকি

গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে গ্যাস লিকেজ (ছিদ্র) থেকে অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৩৪ জন। এরপর গ্যাস বিতরণ লাইনে ১ হাজার ৬২২টি লিকেজ শনাক্ত করার কথা জানায় তিতাস। মেরামতও করা হয় ওই লিকেজ। কিন্তু এরপরও নিয়মিত লিকেজের খোঁজ আসছে তিতাসে। চট্টগ্রামেও ধরা পড়ছে লিকেজ। গ্যাস বিতরণ লাইনে লিকেজের কারণে একদিকে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে রয়েছে বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

ঢাকার তিতাস, সিলেটের জালালাবাদ ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বেশির ভাগ পাইপলাইনের বয়স ৩০ বছরের বেশি। গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে লিকেজের খোঁজ পায় কোম্পানিগুলো। তবে সম্প্রতি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লিকেজ শনাক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে।

চট্টগ্রামে গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি কর্ণফুলীর দুজন কর্মকর্তা জানান, গ্যাস অপচয় ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতেই লিকেজ শনাক্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন অনুসন্ধান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৭টি লিকেজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪৯টি লিকেজ দ্রুত মেরামত করা না হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আছে। তাঁরা বলেন, বাসায় গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইনের গোড়ায় একটি সংযোগ অংশ থাকে, যা রাইজার নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও এসব রাইজার থাকে ঘরের মধ্যে। কোথাও থাকে স্টোর রুম বা বদ্ধ কোনো রুমের ভেতরে। সেখানে লিকেজ থেকে গ্যাস জমে অগ্নিকাণ্ডের মতো বড় দুর্ঘটনায় মানুষ বা সম্পদের বড় ক্ষতি হতে পারে।

কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি সূত্র বলছে, তাদের বিতরণ লাইন ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার লাইনে লিকেজ অনুসন্ধান করা হবে। দেখা যাচ্ছে, পাইপলাইনের চেয়ে রাইজারে লিকেজ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

তিতাসের এক কর্মকর্তা জানান, সব শিল্পকারখানায় মিটার স্থাপন করা হয়েছে। তাই বড় ধরনের চুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে গ্যাস সরবরাহে সিস্টেম লস বা গ্যাসের অপচয় কমার কথা। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিতাসের সিস্টেম লস হয়েছে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। এর আগের দুই বছর এটি ২ শতাংশের কম ছিল। গত অর্থবছরেও এটি ছিল ২ শতাংশ। লিকেজের কারণে গ্যাসের অপচয় হচ্ছেই।

লিকেজ থেকে অগ্নি দুর্ঘটনা

তিতাসের কেন্দ্রীয় জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে প্রতি মাসে গ্রাহকেরা ৫০০ থেকে ৬০০ অভিযোগ করেন। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক গ্যাস লিকেজসংক্রান্ত। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) ৫ হাজার ৪১০টি অভিযোগ আসে, যার মধ্যে গ্যাস লিকেজের অভিযোগ ৪ হাজার ৪৯৬টি। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ হাজার ৩৭৪টি অভিযোগ পায় তিতাস। এর মধ্যে ৫ হাজার ৮৭৬টি ছিল গ্যাস লিকেজের অভিযোগ।

লিকেজের কারণে ২০১৮-১৯ সালে ২০৪টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০৬টিতে।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (অপারেশন) মো. শফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের দুর্ঘটনার পর সব লিকেজ শনাক্ত করে মেরামত করা হয়েছে। এরপর থেকে লিকেজ অনেক কমে এসেছে।

তিতাস সূত্র বলছে, তিতাসের বর্তমান লাইন ১৩ হাজার ১৯৭ কিলোমিটার। সরকারের চলমান উন্নয়নকাজের জন্যও বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস বিতরণ লাইনে লিকেজ হচ্ছে। জানুয়ারি ২০১৭ থেকে জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৩৮টি গ্যাস স্থাপনা অনুসন্ধান করে তিতাস। এতে আবাসিক খাতে ৩৫ হাজার ১০১টি রাইজার, বাণিজ্যিক খাতে ১৫২টি, শিল্প খাতে ৫টি গ্যাসের সংযোগকেন্দ্রে লিকেজ পাওয়া যায়। এগুলো মেরামত করে ২ কোটি ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে তিতাস। তবে মেরামতের পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আবার অনুসন্ধান করে ৪৫২টি সংযোগে পুনরায় লিকেজ পাওয়া যায়, যার ৩৩১টি মেরামত করা সম্ভব হয়। এর সঙ্গে নতুন করে আরও ২৯১টি লিকেজ যুক্ত হয়।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলছে, লিকেজ শনাক্ত করার কাজটি চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে। ধাপে ধাপে অন্য বিতরণ কোম্পানিও করবে। তিতাসের এক কর্মকর্তা বলেন, মানুষের বয়স যত বাড়ে, ওষুধ খাওয়াও তত বাড়ে। তিতাসের অবস্থাও তেমন। এখন পাইপলাইন পরিবর্তন করতে হবে। ঢাকার বিতরণ এলাকাকে ১৪৪টি ব্লকে ভাগ করেছে তিতাস। এর মধ্যে ৬০টি ব্লকে নতুন করে পাইপলাইন স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প ও আবাসিক খাতে গ্যাস দিয়ে অপচয় হচ্ছে। সব বিতরণ লাইনে লিকেজ আছে, এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বিতরণ লাইনে দীর্ঘদিন কাজ করা হয়নি। এখন সব আধুনিক করা হচ্ছে। কোনো লিকেজ থাকবে না, অপচয়ও হবে না।

‘বিশ্ব জ্বালানি দক্ষতা দিবস’ আজ

আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হবে বিশ্ব জ্বালানি দক্ষতা দিবস। জ্বালানি সাশ্রয়, সংরক্ষণ ও জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে ২০১৬ সালে মহাপরিকল্পনা নেয় সরকার। এতে ২০২০ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশ ও ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, জ্বালানি সাশ্রয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় করা গেছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রায়ই দুর্ঘটনার খবর আসে। গ্যাস বিতরণ পাইপলাইন সংস্কারে সরকারের নজর কম। সাশ্রয়ী জ্বালানির প্রশ্নে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। শুধু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এটি হবে না। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ প্রয়োজন।