করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষা সরকার আপাতত একটি ল্যাবরেটরিতে (পরীক্ষাগার) সীমিত রাখতে চায়। আগামীকাল শনিবার থেকে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচ) কুয়েতগামীদের করোনাবিষয়ক স্বাস্থ্য সনদ দেবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের টাকায় কোয়ারেন্টাইন (সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে ব্যবস্থা) অবকাঠামো গড়ে তোলারও পরিকল্পনা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের দুজন শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। সারা বিশ্ব এখন উদ্বিগ এই ভাইরাস নিয়ে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কারও করোনাভাইরাস শনাক্ত না হলেও এ নিয়ে রয়েছে উৎকণ্ঠা। এরই মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আনেন একজন আইনজীবী। পরে হাইকোর্ট করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিদেশ থেকে যাঁরা বাংলাদেশের স্থল, নৌ ও বিমানবন্দর দিয়ে প্রবেশ করছেন, তাঁদের কী ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য মৌখিক নির্দেশনা দেন।
কুয়েতে যেতে স্বাস্থ্য সনদ
কুয়েত সরকার বলেছে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সনদ নিয়ে সে দেশে ঢুকতে হবে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কাছ থেকে এই সনদ নিতে হবে। গতকাল কুয়েত দূতাবাসে গিয়ে তাঁরা এ কথা জানতে পারেন। অনেকেই সঙ্গে সঙ্গে আইইডিসিআরে চলে আসেন।
গতকাল বেলা দেড়টায় রাজধানীর মহাখালীর আইইডিসিআরের সামনে ভিড় করেন জনা পঞ্চাশেক ব্যক্তি। সেখানে কথা হয় মোহাম্মদ রাশেদের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে। ১৯ বছর ধরে কুয়েতে কাজ করছেন। ২০ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরেছেন। ১০ মার্চ তাঁর কুয়েত ফেরত যাওয়ার কথা। হঠাৎ শুনেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন এমন সনদ লাগবে।
রাশেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালে কুয়েত দূতাবাসে গেলে এই হেলথ সার্টিফিকেটের কথা জানতে পারি।’ একই কথা বলেন মিরপুরের মো. আবদুল হাকিম। তিনি কুয়েতে ২০ বছর কাজ করছেন ‘চিলিস-ইউএস রেস্টুরেন্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। কুয়েত দূতাবাস থেকে এদের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, কাগজে লেখা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সনদ আনতে হবে।
>কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আপাতত নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। প্রয়োজনে আইসিডিডিআরবির সহায়তা নেওয়া হবে।
পরে আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, আগামীকাল সকাল নয়টায় মহাখালী আইপিএইচ থেকে স্বাস্থ্য সনদ দেওয়া হবে। আগামী তিন দিনের মধ্যে যাঁদের যাওয়ার কথা, তাঁরা সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। সনদ পেতে প্রত্যেককে পাসপোর্ট ও বিমানের টিকিট দেখাতে হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাস্থ্য সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনা করা হবে। এর মধ্যে আছে গত ১৪ দিনের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো দেশ ভ্রমণের ইতিহাস আছে কি না, ‘কোভিড-১৯’ এর কোনো লক্ষণ আছে কি না। প্রশিক্ষিত চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন। এ ক্ষেত্রে রক্ত বা লালা পরীক্ষার প্রয়োজন হবে না।
এ পর্যন্ত ১০৯ জনের নমুনা (লালা বা রক্ত) পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। কারও করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়নি। সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত ও ইতালিতে আক্রান্ত বাংলাদেশিদের অবস্থা অপরিবর্তিত আছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।
শনাক্তকরণ পরীক্ষার অনুমতি আপাত অন্যদের নয়
আইইডিসিআরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আপাতত নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার যন্ত্র বা রিএজেন্ট থাকলেই চলবে না; জৈবনিরাপত্তা (বায়োসেফটি) আছে এমন ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা করতে হয়। যেন পরীক্ষার সময় স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত না হন।’
এ ধরনের ল্যাবরেটরি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) আছে। করোনা পরীক্ষার প্রযুক্তি ও রিএজেন্টও আছে তাদের। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, এক হাজার নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের আছে। প্রয়োজন হলে আইসিডিডিআরবির সহায়তা নেওয়া হবে।
সূত্রগুলো বলছে, একটি বেসরকারি হাসপাতাল নমুনা পরীক্ষার অনুমতি নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এসেছিল। জানা গেছে, কমপক্ষে চারটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাস পরীক্ষার প্রযুক্তি এনেছে। তবে আইসিডিডিআরবি ছাড়া কারও বায়োসেফটি ল্যাব নেই।
তবে আইসিডিডিআরবি ছাড়া একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যে স্বাস্থ্যকর্মীকে নিরাপদে রেখে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা করার সক্ষমতা তাদের আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও তা জানে।
তৈরি হবে কোয়ারেন্টাইন অবকাঠামো
বিশ্বব্যাংক ‘কোভিড-১৯’ এর মতো সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ১০০ মিলিয়ন ডলার (৮৫০ কোটি টাকা) দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে বলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন।
এই সহায়তা দিয়ে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র করা হবে বলে জানান মীরজাদী সেব্রিনা। তিনি বলেন, ‘এবার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমরা আশকোনা হজ ক্যাম্প ব্যবহার করেছি। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দেওয়া টাকায় নির্দিষ্ট কোয়ারেন্টাইন অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে।’
মোংলায় জাহাজে তিন বিদেশি কোয়ারেন্টাইনে
মোংলা বন্দরে কয়লাবাহী একটি জাহাজের একটি কক্ষে ফিলিপাইনের তিন নাগরিককে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ওই তিনজনের জ্বর ধরা পড়ে। আইইডিসিআরের পরামর্শে তাঁদের পৃথক করে রাখা হয়েছে বলে মোংলা বন্দর হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক মো. আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী এমভি সিরিনিটাস এন নামের জাহাজটি ইন্দোনেশিয়া থেকে ২৪ হাজার টন কয়লা বোঝাই করে প্রথমে সিঙ্গাপুরে আসে, এরপর সেটি চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বুধবার রাত নয়টায় মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের হাড়বাড়িয়া এলাকায় নোঙর করে। গতকাল স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও কর্মীদের একটি দল জাহাজের ২০ জন নাবিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। তখন ফিলিপাইনের তিন নাবিকের জ্বর ধরা পড়ে।
আদালতের নির্দেশনা
বাংলাদেশের স্থল, নৌ ও বিমানবন্দর দিয়ে যাঁরা দেশে প্রবেশ করছেন, তাঁদের কী ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট । বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মৌখিকভাবে গতকাল এ নির্দেশনা দেন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে, এ-সংক্রান্ত জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইসরাত জাহান। এরপর মৌখিকভাবে হাইকোর্ট এই নির্দেশনা দেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বাংলাদেশে রয়েছে—এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী এ-সংক্রান্ত পত্রিকার খবর নজরে আনার পর আদালত মৌখিকভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তিনটি নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী সোমবারের মধ্যে প্রতিবেদন দিয়ে আদালতকে তা জানাতে বলা হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে আদালতের এই নির্দেশনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়েছে।
প্রথম নির্দেশনা, বিদেশ থেকে যাঁরা বাংলাদেশের বিমান, স্থল ও নৌবন্দর দিয়ে প্রবেশ করছেন, তাঁদের কী ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। যাঁরা পরীক্ষা করছেন, তাঁরা প্রশিক্ষিত কি না?
দ্বিতীয় নির্দেশনা, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখার কথা বলেছেন।
তৃতীয় নির্দেশনা, দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম আছে কি না? যদি পর্যাপ্ত না থাকে, জরুরি ভিত্তিতে এসব সরঞ্জাম আমদানি করা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি আদালতের নজরে আনা আইনজীবী ইসরাত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর আমরা দেখেছি, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে কী অবস্থা দাঁড়িয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশের সব জাতীয় দৈনিকে প্রতিদিনই খবর প্রকাশিত হচ্ছে, জীবনঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি, বিদেশ থেকে যাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন, করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য তাঁদের যথাযথ পরীক্ষা করা হচ্ছে না। পরিচিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ে যে হিমশিম অবস্থা, সেখানে অজানা করোনাভাইরাস নিয়ে কেমন অবস্থা দাঁড়াতে পারে!’