গত বছর একদিন ফোনে কথা হচ্ছিল গুণী গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীর সঙ্গে। মূলত কাজী মোতাহার হোসেন ও তাঁর কিছু জীবনতথ্য বিষয়ে কথা বিনিময় করতে গিয়ে আমরা দুজনই অবাক হলাম এই ভেবে যে সন্জীদা খাতুন, আমাদের আপা ৮৫ পেরিয়ে এখনো তাঁর পিতার রচনাবলি-জীবনী এই সব নিয়ে কাজ করে চলেছেন, যেমন তিনি সারা জীবন করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের চর্চা আর বাঙালি সংস্কৃতির সাধনা। পথে পথে পাথর জমেছে ঢের, তবে তিনি সে কঠিন পথকে পলিময় করতে সংস্কৃতির আলোকশিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন নিরন্তর।
‘সন্জীদা খাতুন’ নামটি উচ্চারণ করলে আজ অনায়াসেই চলে আসে ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, নালন্দা বিদ্যালয়, ব্রতচারী আন্দোলন, পয়লা বৈশাখ এবং অনিঃশেষ রবীন্দ্রনাথ। শুধু কি রবীন্দ্রনাথ! তিনি পথিকৃৎ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-গবেষকও বটে। সাম্প্রতিক সময়ে নজরুল ও জসীমউদ্দীন-অন্বেষায়ও তিনি নিবিড় নিবিষ্ট। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে তাঁর উদ্ভাবন-শ্রম-মেধা ও মনীষার অনুপম প্রকাশ ঘটেনি।
পাকিস্তানি রাষ্ট্রপক্ষ সন্জীদা খাতুনকে স্বস্তি দেয়নি; বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের ‘অপরাধে’ কলেজে শিক্ষকতাকালে ঢাকা থেকে বদলি করা হয়েছে সুদূর রংপুরে। তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল নিরস্ত হয়ে যাওয়া, কিন্তু সন্জীদা খাতুনের অভিধানে ‘নিশ্চলতা’ বলে কোনো শব্দ নেই; সে জন্যই ২০০১ সালে রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে ভয়ংকর বোমাবর্ষণের পরও তিনি বলতে পারেন, বাঙালির সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চলবেই।
সন্জীদা খাতুন অনিরুদ্ধ বাঙালিত্বের প্রতীক-মানবী। কাজী মোতাহার হোসেন এবং সাজেদা খাতুনের সন্তান সন্জীদা খাতুন ঐতিহ্যবাহী পরিবারের পরম্পরা রক্ষা করেননি শুধু, নিজেই সৃষ্টি করেছেন নতুন ঐতিহ্যধারা। বায়ান্নর মিছিল থেকে অদ্যাবধি বাঙালির সংস্কৃতির বাতি হাতে অন্ধকারের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। একুশ তাঁকে ভাষা দিয়েছিল, একাত্তরে সুরের আগুনকে অস্ত্র করে তুলেছেন তিনি। তাঁকে আমরা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে, রূপান্তরের গান-এ, মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সভাপতিরূপে। অর্ধশতাব্দীকালের অনলস সাধনায় বাংলা নববর্ষ উৎসবকে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসবে রূপদানের অন্যতম পুরোধা তিনি।
সন্জীদা খাতুন একলা চলার অভীক। আবার সবাইকে নিয়েই তাঁর আলোর অভিযাত্রা। পাকিস্তান আমলে বাংলা একাডেমিতে অত্যল্পকালের পেশাজীবনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র অমর কীর্তি আঞ্চলিক ভাষার অভিধান-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যেমন, তেমনি ফিরোজা বেগম সংকলিত কয়েক খণ্ডের নজরুলসংগীত স্বরলিপি পুস্তকাকারে প্রকাশে রেখেছেন উদ্যোগী ভূমিকা। শুচিস্নিগ্ধ মানুষটি এই বাংলার প্রিয় প্রকৃতির মতোই, এ শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে যেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতাকালে তিনি কয়েক প্রজন্মের শিক্ষার্থীর প্রিয় শিক্ষক, এখানে রবীন্দ্রপাঠের সনাতনি পাঠক্রমের অন্ধ অনুবর্তনের পরিবর্তে তিনি নতুন ধারার সমালোচনা পদ্ধতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।রাগসংগীতের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গিয়ে তিনি বিস্মৃত হন না লোকসংগীতের শক্তিকে।
আজ আমরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচক পরিমাপ করছি কিন্তু এ জাতির সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার সূচকও একই সঙ্গে নির্ধারণ করা জরুরি। করলে দেখতে পাব এতে সন্জীদা খাতুনের অবদান অসামান্য।
অসামান্য সেই সন্জীদা খাতুনকে নিয়ে একটি সম্মাননা স্মারকের পরিকল্পনা নিলাম আমরা। প্রকাশে এগিয়ে এলেন শোভা প্রকাশের প্রকাশক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। কাজ শুরু করে টের পেলাম এমন বহু বিভাময় মানুষের জীবনকৃতিকে একটি বইয়ের পরিসরে ধারণ করা অসম্ভব ব্যাপার প্রায়। তবু আমাদের লক্ষ্য ছিল সন্জীদা-পরিবারের সদস্য, শিক্ষার্থী, দুই বাংলায় বিস্তৃত তাঁর গুণগ্রাহী—সবার লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন ও সৃষ্টির বৈচিত্র্যকে কিছুটা হলেও পাঠকের কাছে উন্মোচন করা।
এই বইয়ে প্রকাশিত কবি শঙ্খ ঘোষের লেখায় আছে সেই সত্যের উন্মোচন, যে ‘গানই তাঁর জীবন’—
‘গান গাইতেই তাঁর আনন্দ, গান শোনানোতেই তাঁর আনন্দ। কেননা গান তাঁর কাছে কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, গান তাঁর জীবিকা নয়, গান তাঁর জীবন।’
সন্জীদা খাতুনের সহোদরা, আমাদের আরেক প্রিয় শিল্পী ফাহ্মিদা খাতুন তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন পরিবারের এই প্রিয় মুখের প্রতিকৃতি—
‘আম্মুকে হারানোর পরে, কেন্দ্রবিন্দুতে এখন মিনু। যা কিছু ভালো–মন্দ হলেই পরিবারের সকলেই ছুটে আসে মিনুর কাছে, সুখ-দুঃখের কথা বলে মনটাকে হালকা করার জন্য—সবার ভরসা তিনি।’
এই বই যেমন কাছের-দূরের বৃহৎ বাঙালির ভরসা সন্জীদা খাতুনকে ঘিরে স্মৃতির লেখমালা তেমনি বই প্রকাশেও বহু বেদনার স্মৃতিঢেউ আছড়ে পড়েছে। কথা ছিল বইটি প্রকাশিত হবে ৪ এপ্রিল ২০২০, আপার ৮৭তম জন্মবার্ষিকীতে; আপার প্রিয়জন আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে বইটির প্রকাশনা উৎসবের ভাবনাও চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনার আগ্রাসন সব পরিকল্পনাই ভেস্তে দিল। আনিসুজ্জামান স্যারও অনন্তের পথে পাড়ি দিলেন। এর মধ্যে একে একে বিদায় নিলেন এই বইয়ের আরও দুজন লেখক—দেবেশ রায় ও অরুণ সেনও।
দেরিতে হলেও বইটি প্রকাশিত হলো—বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে—সন্জীদা খাতুন সম্মাননা–স্মারক (সম্পাদক আবুল আহসান চৌধুরী ও পিয়াস মজিদ)। আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু তবু এই বইয়ে সংকলিত আনিসুজ্জামানের লেখার শেষ কটি পঙ্ক্তিতেই যেন সন্জীদা খাতুনের উদ্দেশে নিবেদন করা যায় কৃতজ্ঞ বাঙালির জাতির অভিবাদন—
‘তাঁকে অভিনন্দন এক সৃজনশীল জীবনযাপনের জন্যে। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কীর্তির মধ্যে, তাঁর অনুরাগীদের ভালোবাসায়। জয় হোক তাঁর।’
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক