প্রথম আলো

একটি পত্রিকার স্বপ্ন, একটি পত্রিকার জন্ম

প্রকাশনার ২২ বছর পূর্ণ করল প্রথম আলো। এর প্রকাশনার শুরু ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর। কিন্তু এর স্বপ্ন, ধারণা ও উদ্যোগ শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেই। দেশজুড়ে পড়েছিল তার আন্তরিক সাড়া। পাঠক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন মহলে জেগেছিল তীব্র কৌতূহল। তারই ছাপ পড়েছিল প্রকাশনা উপলক্ষে সে বছরের অক্টোবর মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রীতিসমাবেশে। প্রথম আলো প্রকাশ উপলক্ষে বেরোনো বুলেটিন থেকে শুরুর আগের সেই দিন।

প্রথম আলোর প্রকাশনা উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ বুলেটিন। অক্টোবর ১৯৯৮
প্রথম আলোর প্রকাশনা উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ বুলেটিন। অক্টোবর ১৯৯৮

বুলেটিনটি ছিল স্বপ্নে ভরা। কিছু দিন পরেই প্রথম আলো প্রকাশিত হবে। সারা দেশে তা নিয়ে জল্পনা। কেমন হবে সে পত্রিকা, কী তার সম্পাদকীয় অবস্থান, কারা থাকবে পত্রিকাটিতে—কৌতূহলের শেষ নেই। সেসবেরই জবাব নিয়ে বের হলো বিশেষ বুলেটিনটি। তাতে ধরা রইল প্রথম আলোর স্বপ্ন আর সম্পাদকীয় নীতির অঙ্গীকার।

প্রথম আলো হয়ে উঠতে চেয়েছিল বাংলাদেশের সামনের কাতারের মানুষের ভাবনা প্রকাশের প্রধান ক্ষেত্র। ঢাকার এক সন্ধ্যায় বসল সেই গুণীজনদের সমাবেশ। বুলেটিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সেই অতিথিদের তালিকা।

প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে...প্রথম আলোর প্রথম সম্মিলন

৩ অক্টোবর ১৯৯৮ বিকেল থেকে সন্ধ্যা। ‘কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনের মিলনায়তনে যদি দৈবাৎ ফাটত একটা বোমা, তবে সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ পড়ে যেত অপূরণীয় মেধার আকালে।’ মন্তব্যটি একসময়কার টিভি প্রযোজক বেলাল বেগের। যে কাগজটি এখনো দিনের আলো দেখেনি, তারই প্রীতিসম্মিলনে যোগ দিয়েছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষেরা। রবীন্দ্রনাথের ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি’ গান দিয়ে শুরু হয় সম্মিলন। গানের রেশ কাটতে না কাটতেই মঞ্চে ওঠেন কবি শামসুর রাহমান, প্রথম আলোকে শুভেচ্ছা জানাতে।

একে একে মঞ্চে উঠে প্রথম আলোকে অভিনন্দিত করে বক্তব্য দেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আবুল মাল আবদুল মুহিত, ফারুক চৌধুরী, সাবেক কেবিনেট সচিব মুজিবুল হক, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পপতি লতিফুর রহমান, সাংবাদিক এবিএম মূসা, রাশেদা কে চৌধূরী, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব জাকারিয়া পিন্টু, অভিনেতা আলী যাকের প্রমুখ।

প্রথম দিনের প্রথম আলো, ৪ নভেম্বর ১৯৯৮

প্রথম আলোর কাছে নির্ভীক, বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সাংবাদিকতার প্রত্যাশা জানিয়ে তাঁরা বলেন, ভোরের কাগজ-এর সাবেক সম্পাদক মতিউর রহমান ও তাঁর সহকর্মীদের প্রতি আস্থা রাখা যায়। কেননা তাঁরা পরীক্ষিত সংবাদকর্মী। সুধীজনের বক্তৃতার শুরুতেই প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান নির্ভীক, বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সাংবাদিকতার প্রতি অঙ্গীকার প্রকাশ করেন।

ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক ও প্রথম আলোর প্রকাশক মাহ্‌ফুজ আনাম সংবাদপত্র পরিচালনায় সম্পাদক ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার প্রতি তাঁর আস্থা প্রকাশ করে বলেন, সংবাদপত্র কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অভিপ্রায় প্রকাশের বাহন হতে পারে না।

মঞ্চে ওঠেননি, কিন্তু সম্মিলনে উপস্থিত থেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা কাজী ফজলুর রহমান, সরদার ফজলুল করিম, কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ আলী কবীর, প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ, ফয়েজ আহ্‌মদ, শাহাদত চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, রাশেদ খান মেনন, রফিকুন নবী, বশীর আল্‌হেলাল, হুমায়ুন আজাদ, নাট্যজন আতাউর রহমান, সারা যাকের, চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিনায়ক সেন, কবি মহাদেব সাহা, মালেকা বেগম, শিরিন হক, আতহার আলী খান প্রমুখ।

বক্তৃতার ফাঁকে বোনাস হিসেবে ছিল গান। শুভেচ্ছা জানাতে এসে গান গেয়ে শুনিয়েছেন ড. আনিসুর রহমান ও নিলুফার ইয়াসমীন। গেয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু, মাকসুদুল হক, রবি চৌধুরী ও ডলি সায়ন্তনী। আইয়ুব বাচ্চু হারমোনিয়ামে আর মাকসুদুল হক খালি গলায় গেয়েছেন। উপস্থিত ছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরী ও এস ডি রুবেল। জাদু না দেখালেও কথার জাদু বিস্তার করেছিলেন জাদুকর জুয়েল আইচ। হানিফ সংকেত নিজে না হেসে, অন্যদের হাসাতে হাসাতে অনেক সিরিয়াস কথাই শোনালেন সংবাদপত্র সম্পর্কে। আসাদুজ্জামান নূরের মন্দ্রমধুর কণ্ঠে পরিবেশিত নূরল দীনের সারাজীবন নাটকের ভূমিকাংশের পাঠ স্মৃতি হয়ে থাকবে।

তারকারাও অনুপস্থিত থাকেননি প্রীতিসম্মিলনে। এসেছিলেন রাজ্জাক ও চম্পা। আব্দুন নূর তুষার, ফেরদৌস, পূর্ণিমা ও বিজরী ছিলেন সারাক্ষণই। সম্মিলনের শেষান্তে পপিকেও যোগ দিতে দেখা গেছে।

মঞ্চে কোনো সভাপতির উপস্থিতি ছিল না, ছিলেন না আলোচকবৃন্দও। উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছিলেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক আনিসুল হক।

এই অতিথিদের অনেকেই এখন শারীরিকভাবে গত, কিন্তু প্রথম আলোর অগ্রযাত্রায় তাঁদের ভূমিকা ছিল অসামান্য, সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত নিবিড়। চট্টগ্রামেও হয়েছিল আরেকটি প্রীতি সম্মেলন। চোখ ফেরানো যাক বুলেটিনে।

চট্টগ্রামে প্রথম আলো সন্ধ্যা

দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশ–পূর্ব এক প্রীতিসম্মিলন চট্টগ্রামেও অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১০ অক্টোবর।

সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরের মেহেদীবাগের রয়েল গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এই প্রীতিসম্মিলনীতে বক্তব্য দেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও প্রথম আলোর প্রকাশক মাহ্‌ফুজ আনাম।

অনুষ্ঠানে প্রথম আলো পত্রিকার প্রকাশনার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আবদুল মান্নান, ক্রিকেট তারকা মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আকরাম খান, লোকসংগীতশিল্পী শেফালী ঘোষ, সোলসের গায়ক নাসিম আলী খান।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন চট্টগ্রামে প্রথম আলোর আবাসিক সম্পাদক আবুল মোমেন। একই ধরনের মতবিনিময় সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়েছে সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, যশোর ও ময়মনসিংহে।

কারা লিখবেন প্রথম আলোতে, বিশেষ বুলেটিনে বেরিয়েছিল তারও একটি তালিকা। তার অংশবিশেষ:

প্রথম আলোর লেখক-কলামিস্ট

প্রথম আলোয় নিয়মিত লিখবেন দেশের সেরা লেখক-কলামিস্টরা। লিখবেন সুফিয়া কামাল, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শামসুর রাহমান, সরদার ফজলুল করিম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আনিসুজ্জামান, এবিএম মূসা, আতাউস সামাদ, ফারুক চৌধুরী, আবেদ খান, নওয়াজেশ আহমদ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, হাসান আজিজুল হক, মুনতাসীর মামুন, মনিরুজ্জামান মিঞা, আবুল মোমেন, হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মফিদুল হক, নিমচন্দ্র ভৌমিক, রাশেদ খান মেনন, সন্‌জীদা খাতুন, সালমা খান, মালেকা বেগম, নাসরীন জাহান; বিদেশ থেকে হাসান ফেরদৌস, মনজুরুল হক প্রমুখ। সারা দেশের সংবাদদাতা ও প্রতিনিধিদের অগ্রসর কীর্তিমান অংশের সমর্থন ও অংশগ্রহণ প্রথম আলোর প্রধান শক্তি। দেশের বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রথম আলোকে সহযোগিতার আশ্বাস জানাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

কারা যোগ দিচ্ছেন প্রথম আলোয়, তা নিয়েও ছিল কৌতূহল। বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদকর্মীদেরও তালিকা:

প্রথম আলোয় কারা থাকছেন

ভোরের কাগজ-এর সাবেক সম্পাদক মতিউর রহমান তো থাকছেনই; সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোয় যোগ দিয়েছেন ভোরের কাগজ-এর সাংবাদিকদের অনেকেই। নিচের তালিকাটা পড়লেই তা বোঝা যাবে।

সম্পাদকীয় বিভাগে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবাই—আব্দুল কাইয়ুম, এটিএম হাই, সাজ্জাদ শরিফ, আনিসুল হক, একেএম জাকারিয়া, মশিউল আলম। বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, বিশেষ প্রতিনিধি সানাউল্লাহ, প্রধান প্রতিবেদক অরুণ কর্মকার, শাহেদ মুহাম্মদ আলী, প্রণব সাহাসহ অনেকেই আছেন।

মফস্বল সম্পাদক লতিফ সিদ্দিকী, অন্যপক্ষের বিভাগীয় সম্পাদক সুমনা শারমীন, অবসরের মুনির রানা, রংধনুর কবির বকুল ও মেহেদী মাসুদ, রঙ্গব্যঙ্গর সাইদুজ্জামান রওশন, একুশ শতকের মুনির হাসান, লেখাপড়ার মাহমুদ ইকবালসহ ফিচার পাতার সম্পাদক-কর্মীই আছেন প্রথম আলোয়।

স্পোর্টস বিভাগের উৎপল শুভ্র, সাইফুর রহমান খোকন ও পবিত্র কুণ্ডু যোগ দিয়েছেন নতুন দৈনিকে। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য, অশোক কর্মকার ও বিপুল শাহর তুলির টান ফুটবে প্রথম আলোয়। উপদেষ্টা হিসেবে থাকছেন প্রখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন যুক্ত থাকছেন প্রথম আলোর সঙ্গে, যেমন রয়েছেন চারণ সাংবাদিক বেলাল বেগ। আছেন অভিজ্ঞ সাকু‌র্লেশন ম্যানেজার এবিএম জাকারিয়া আর বিজ্ঞাপন ম্যানেজার রশিদুর রহমান সবুর।

এঁদের কেউ কেউ হয়তো গত হয়েছেন, কেউ কেউ অন্যত্র কর্মরত। কিন্তু প্রথম আলো আজ যেখানে এসেছে, সেখানে আছে সবারই মিলিত পদক্ষেপ।

কী ছিল প্রথম আলোর অঙ্গীকার, কেমন হবে প্রথম আলো

  • প্রথম আলো হবে ১০০% নির্দলীয় কাগজ।

  • প্রথম আলোয় খবর থাকবে বেশি। খবরের বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করা হবে। মঞ্চ ও নেপথ্যের খবর, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সরেজমিন প্রতিবেদনের ওপর জোর দেওয়া হবে খুবই।

  • দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, আন্তর্জাতিক চেতনা, নারী অধিকারের পক্ষে থাকবে প্রথম আলো।

  • সব ধরনের দুর্নীতি–অনিয়ম, ঋণখেলাপ, অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে প্রথম আলো থাকবে সোচ্চার।

  • মেকআপ–গেটআপ, লেখায়–রেখায় কাগজ হবে আধুনিক, কম্পিউটার–সজ্জিত, রঙিন।

  • নিজ নিজ এলাকার খবর, ব্যবসা–বাণিজ্যের খবর, লেখাপড়া, বিনোদন, নারী, শিশু–কিশোর, তারুণ্য, সাহিত্য–শিল্প–সংস্কৃতি, কৌতুক–কার্টুন, বিজ্ঞান–কম্পিউটার, খেলাধুলাসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ছুঁয়ে যাবে প্রথম আলো

কেন নতুন কাগজ

শাহাবুদ্দি মিয়া ঢাকার একটি রেস্তোরাঁর গার্ড। তিনি পড়েন রোজ দুটি কাগজ। কারণ, তাঁর ভাষায়, একটায় থাকে সরকারপক্ষের কথা, আরেকটায় লেখা হয় বিরোধীপক্ষের কথা। দুটো পত্রিকা পড়ে তিনি বোঝার চেষ্টা করেন আসলে কী ঘটেছে!

প্রথম আলোর প্রয়োজনটা ঠিক এই জায়গায়। একটা কাগজ পড়েই যেন বোঝা যায় প্রকৃত ঘটনা। প্রথম আলো হতে চায় সম্পূর্ণ নির্দলীয়, ১০০% বস্তুনিষ্ঠ। সত্য কথাটা সরাসরি বলে ফেলাটা কঠিন, কিন্তু বলাটা ভীষণ জরুরি। প্রথম আলো পত্রিকার সাংবাদিকদের পক্ষে তাঁদের পুরোনো প্ল্যাটফর্ম থেকে এ কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল ইদানীং। সে কারণেই নতুন কাগজ প্রথম আলো