দেশের সংস্কৃতিচর্চা কোন পথে

‘একটা বিচ্ছিন্নতা ও শূন্যতা তৈরি হয়েছে’

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে এসে বাংলাদেশের সংস্কৃতির হাল–হকিকত এখন কেমন? বাঙালির বর্ষবরণের ক্ষণে তা বুঝে নিতে প্রথম আলো মুখোমুখি হয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠক, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
ছবি : প্রথম আলো
প্রশ্ন

১. ১৯৫০–৬০–এর দশকে এ দেশের সংস্কৃতিচর্চা অভূতপূর্ব কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। অতিমারির সময়টুকু বাদ দিলে দেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু অনেকে বলছেন, এই চর্চা থেকে দেশের বৃহত্তর মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা : মুক্তিযুদ্ধের আগে আমরা যে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করেছিলাম, তার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা ছিল নিজেদের অধিকার আদায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। শিক্ষিত ও সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাত ধরেই সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে সবাই সরব হয়েছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর সে প্রয়োজন অনেকটা থিতিয়ে যায়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর আবার একটা প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন সংস্কৃতিকর্মীরা আবার লড়াই করেছেন। এ কথা সত্য যে এখনকার প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতিচর্চা মানুষের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আমার ধারণা, এর দুটো কারণ রয়েছে। ১. আগের মতো গ্রামের মানুষের সাংস্কৃতিকভাবে তৎপর থাকতে না পারা; ২. শহরের মানুষের জীবনে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রভাব।

গ্রামগঞ্জে এখন আর আগের মতো বারো মাসে তেরো পার্বণ হয় না। মেলা বা যাত্রাপালা করার মতো পরিবেশ গ্রামে আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না। এই সুযোগই নিচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধী পক্ষ। ধর্ম তো মানুষের মধ্যে শুভবোধই জাগায়, কিন্তু ধর্মকে এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিগত বছরগুলোয় গ্রামে ওয়াজের সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে সাম্প্রদায়িকতাও। কারণ, নির্মল বিনোদনের কোনো উপকরণ গ্রামের মানুষের কাছে নেই। ফলে তারা মাথা গুঁজে দিচ্ছে এসব পশ্চাৎপদ চর্চার মধ্যে।

আবার আকাশ সংস্কৃতির কারণে শহরে সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ঘটেছে। সবার হাতে হাতে অনলাইনের বিচিত্র সম্ভার। নাগরিক মানুষের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি এখন অনেকটাই বহির্মুখী। শহরে বাঙালি সংস্কৃতির সুর আর আগের তারে বাজে না। সবটা মিলিয়েই একটা বিচ্ছিন্নতা, একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন

২. স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে সরকারি–বেসরকারি নানা স্তরে দুই বছর ব্যাপক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখান থেকে কতটা ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারলাম?

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা : এর উত্তর এ মুহূর্তে বলা কঠিন। অনুষ্ঠানগুলো তো মাত্রই হলো। এসবের প্রভাব কত দূর পৌঁছাল, আরও কিছুদিন পর হয়তো সেটা বলা সহজ হবে। এ উপলক্ষে অনেক অনুষ্ঠান হয়েছে, অনেক বই বেরিয়েছে। এর সবকিছুই যে সবাইকে স্পর্শ করবে, এতটা আশা করা ঠিক নয়। সংখ্যা যত বাড়বে, গুণগত মানও সে অনুপাতে ততই বাড়বে। ওখানেই আমাদের আশা।

করোনার বাস্তবতার কারণে জনসাধারণের কাছে আয়োজনগুলো ততটা পৌঁছানো যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী আর মুজিব বর্ষের সব অনুষ্ঠান সব কটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানোর কথা ছিল। অথচ প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানসহ যে আলোচনা অনুষ্ঠান ছিল, সেগুলোর ওপরই কেবল গুরুত্ব দিল চ্যানেলগুলো। বিটিভি ছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো আর কেউ দেখাল না। অনুষ্ঠানগুলো দেখার কোনো সুযোগই মানুষের হলো না।

প্রশ্ন

৩. মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ধরনের সমাজ ও মূল্যবোধের স্বপ্ন আমরা দেখেছি, তা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের সংস্কৃতিকে এখন কীভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারি? আমাদের কী করা উচিত?

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা : সোনার বাংলার জন্য সোনার মানুষ গড়ে তোলা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ধরনের সমাজ ও মূল্যবোধের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তা বাস্তবায়ন করতে হলে সংস্কৃতিচর্চাকে শিক্ষাব্যবস্থার আবশ্যিক অংশ করে তুলতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে। পাঠ্যপুস্তকে যেসব সাম্প্রদায়িকতার উপাদান ঢোকানো হয়েছে, সেসব বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে। চরিত্র গঠনের জন্য প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা তো সংগীত বিদ্যায়তন পরিচালনা করি, গান শেখাই। ছোট বাচ্চারা স্কুলে এসে যা বলে, তাতে ঘাবড়ে যেতে হয়। তাদের কচি মনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকে যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আমি মনে করি, ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের মনে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ তৈরি করা দরকার, তাদের মনে এর প্রতি ভালোবাসা তৈরি করা দরকার। আমাদের একে অপরের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার বোধও দূর করা প্রয়োজন।