কবরী

একজীবনের অসীম অতৃপ্তি

সারাহ বেগম কবরী
সারাহ বেগম কবরী

চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজার থেকে মিনা নামের মেয়েটি যখন ঢাকার চলচ্চিত্রজগতে এসে পা রেখেছেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩। রুপালি পর্দার মোহে তো নয়ই, নিজের ইচ্ছায়ও নয়, এসেছিলেন বাবার জোরাজুরিতে। অসচ্ছল পরিবারটির জন্য বাড়তি কিছু আয়ের দায় এসে পড়েছিল ছোট্ট কাঁধে। জে এম সেন স্কুলের মেয়েরা যখন ইউনিফর্ম আর দুকাঁধে কলা বেণি দুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, পাড়ার মেয়েরা হাডুডু আর চি-কুতকুত খেলার আনন্দময় শৈশবে মেতে আছে, মিনাকে তখন দাঁড়াতে হলো আলো ও ক্যামেরার সামনে। অভিনয়ের প্রথম পাঠটিও শিখে আসেননি, এক–আধটু নাচ জানতেন, এটুকুই তো পুঁজি। কিন্তু সুভাষ দত্ত পরিচালিত সুতরাং ছবিটি যখন মুক্তি পেল, তখন দর্শকের উজাড় করা ভালোবাসায় সিক্ত মিনা, সুভাষ দত্তের নায়িকা কবরী। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। তখনকার সময়ের জনপ্রিয় সিনেমা পত্রিকা চিত্রালীতে নবাগত নায়িকা সম্পর্কে সচিত্র সংবাদের শিরোনাম, ‘আসলাম, দেখলাম, জয় করলাম। ’

এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাহানা, চাওয়া পাওয়া, সাত ভাই চম্পা, আবির্ভাব—একের পর এক দর্শকনন্দিত ছবির নায়িকা কবরী।

দীর্ঘাঙ্গী নন; খাড়া নাক, রাজহাঁসের গ্রীবা, এমনকি পটলচেরা চোখও নয়, তাহলে কী জাদুতে দর্শকচিত্ত জয় করলেন? উত্তর একটাই—নবকৈশোরের সারলে৵ ভরা মুখ, অপূর্ব সুন্দর হাসি আর সহজাত অভিনয়প্রতিভা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতে ‘মিষ্টি মেয়ে’ নামে স্থায়ী আসন তৈরি হয়ে গেল তাঁর।

ক্যারিয়ারের শুরুতেই সাফল্যের দেখা মিলল, কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে সুখ হাত ধরাধরি করে হাঁটবে, এমন কোনো ধরাবাঁধা কথা নেই। কবরীর কর্মজীবন তাই যতটা আলোঝলমলে, ব্যক্তিগত জীবন ততটাই অতৃপ্তি ও অপ্রাপ্তির খতিয়ান। বিভিন্ন সময়ে আলাপচারিতা ও পত্রপত্রিকার সাক্ষাত্কারে অকপটে এ অতৃপ্তির কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

কম বয়সে বিয়ে হয়ে গেল চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গে। এটাও নিজের ইচ্ছায় নয়। কারণ, নিজের স্বাধীন মতামত প্রকাশের বয়সটা তখনো হয়নি। প্রথম জীবনে ভালো লেগেছিল এক তরুণ চিকিত্সককে, তিনিও ভালোবেসেছিলেন মিনাকে। কিন্তু মিলনের পূর্ণতা পায়নি সেই প্রেম। সেই জীবনকে ফেলে আসতে হয়েছে চট্টগ্রামের এক শহরতলিতে, কারণ মিনা এখন কবরী, ঢাকার চলচ্চিত্রজগতের ব্যস্ত তারকা।

একদিকে বাহানা, সোয়ে নদীয়া জাগে পানি, মেরে সনম-এর মতো উর্দু ছবি, অন্যদিকে সাহিত্যনির্ভর কাহিনির পাশাপাশি রূপবান, আবার বনবাসে রূপবান, পারুলের সংসার, সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণমালার মতো রূপকথা ঘরানার ছবিতেও কাজ করেছেন কবরী। দম ফেলার ফুরসত নেই তখন।

খান আতাউর রহমান পরিচালিত সোয়ে নদী জাগে পানি ‘মস্কো-তাসখন্দ আফ্রো-এশিয়ান ফেস্টিভ্যাল’–এ প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু বাংলা ছবির দর্শকেরা যেভাবে বিপুল ভালোবাসায় বরণ করেছিলেন কবরীকে, সেভাবে তাঁর উর্দু ছবিগুলো জনপ্রিয়তা পায়নি। সম্ভবত তাঁর চেহারার মধ্যেই ছিল আদি ও অকৃত্রিম এক বাঙালি মেয়ের প্রতিকৃতি, যা তাঁকে দর্শকের মনে জায়গা করে দিয়েছিল।

খ্যাতির প্রায় মধ্যগগনে যখন, তখনই শুরু হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তত দিনে কবরী তারকা শুধু নন, সমাজসচেতন একজন মানুষ। তাঁর চারপাশে তখন জহির রায়হান, খান আতা, এস এম পারভেজ, আনিস চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হকের মতো দেশের সংস্কৃতিজগতের গুণী মানুষের ভিড়। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা পাননি বলে বড় একটা আফসোস ছিল জীবনে, এঁদের সান্নিধ্য আর নিজের জানার কৌতূহল, শিক্ষার প্রতি অদম্য অনুরাগ ক্রমেই শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমান করে তুলেছিল তাঁকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছেছিলেন। সেখানে কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে। ভারতের কলকাতা-বোম্বে–দিল্লি-হায়দরাবাদসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছেন, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রক্ত সংগ্রহ করেছেন।

বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) বি আর চোপড়া পরিচালিত জয় বাংলা নামের একটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। সেই একাত্তর সালে পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা। এর অর্ধেক ১০ হাজার টাকা তিনি মুক্তিযুদ্ধ তহবিলের জন্য দান করেছিলেন বাংলাদেশ হাইকমিশনে। বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নেওয়ার সুযোগও হয়েছিল তখন। সেখানকার খ্যাতিমান পরিচালক শক্তি সামন্ত, সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী, নায়ক-নায়িকা দিলীপকুমার, ধর্মেন্দ্র, সুনীল দত্ত, দেব আনন্দ, বিশ্বজিৎ, নার্গিসদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিখ্যাত ‘রাজশ্রী প্রোডাকশন’ একটি ছবির জন্য অগ্রিমও দিয়েছিল। কিন্তু কেন যেন মন টেকেনি। তাঁর স্বপ্ন ও অপেক্ষা কখন দেশ স্বাধীন হবে, কবে আবার বাংলার আপামর দর্শকের ‘মিষ্টি মেয়েটি’ তাদের প্রতীক্ষিত হাসি-কান্নার গল্পে ফিরে যাবে, আবার বাংলাদেশের পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ মুখরিত হবে মুহুর্মুহু করতালিতে।

দেশ স্বাধীন হলো। একেবারে নতুন করে শুরু হলো যাত্রা। কবরী ফিরে পেলেন তাঁর হারানো আসন। এখন আরও পরিণত তাঁর অভিনয়, আরও তীব্র আমন্ত্রণ তাঁর কটাক্ষে। রংবাজ, সুজন সখীর চপল চঞ্চল নায়িকা লাখো তরুণের রাতের ঘুম কেড়ে নেন। ‘হৈ হৈ হৈ রঙিলা, রঙিলা রে...’ গেয়ে সিক্তবসনা সুন্দরীর দেহবিভঙ্গ বা ‘গুনগুন গুন গান গাহিয়া নীল ভোমরা যায়...’ গেয়ে সখী–পরিবেষ্টিত গ্রাম্য তরুণীর দুষ্টু–মিষ্টি দৃষ্টির আমন্ত্রণ উতলা করে তুলেছিল দর্শককে। আবার অন্যদিকে তিতাস একটি নদীর নাম–এর নতুন বউটি বা সারেং বৌ–এর নবীতুনের চরিত্রে সেই একই শিল্পী যে মর্মস্পর্শী অভিনয় করেছেন, তার তুলনা তো এ দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল।

অভিনয়ের পাশাপাশি সামাজিক ও জনহিতকর কাজে যুক্ত হয়েছিলেন কবরী। নেমেছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতেও। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের তীব্র বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে জয়লাভ করেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী সরোয়ার তাঁকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছিলেন। কারণ, ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সরোয়ার। কিন্তু পিছু হটতে রাজি না হওয়ায় কবরীকে বলা হয়েছিল সরোয়ার পদবি ত্যাগ করতে। নির্দ্বিধায় নাম পরিবর্তন করে সারাহ্ বেগম কবরী নামে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ঘরে-বাইরে লড়ে, জয়ী হয়ে সেদিন নিজের তুঙ্গস্পর্শী মনোবল ও একাগ্রতার প্রমাণ দিয়েছিলেন কবরী। অবশ্য এই রাজনৈতিক জীবনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকল না পরবর্তীকালে নির্বাচনে আর দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায়। সে অন্য প্রসঙ্গ।

২০০১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব ‘মিলেনিয়াম ফেস্টিভ্যালে’র চেয়ারপারসন ছিলেন তিনি। মানসম্পন্ন এক উত্সবের আয়োজন করে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন কবরী। আগেই বলেছি, গুণী মানুষদের সান্নিধ্যে থেকে তাঁদের আলোকস্পর্শে নিজেকে আলোকিত করেছেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় মাধ্যমিকের গণ্ডি ছড়ানোর সুযোগ পাননি, অথচ রুচি-শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের এমন এক বিরল সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর চরিত্রে, যা বিস্ময়কর।

এই ব্যক্তিত্বের জোরেই বিদ্বৎসমাজে সমীহ পেয়েছেন, আবার সংসারজীবনে প্রকৃত সঙ্গ ও সাহচর্যলাভে বঞ্চিত হয়েও নিজের চারটি পুত্র–সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, বিদেশে প্রতিষ্ঠালাভের সুযোগ করে দিয়েছেন। একটি সন্তান শারীরিক প্রতিবন্ধী, শেষ দিন পর্যন্ত তাকে আগলে রেখেছেন মাতৃস্নেহে।

অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার পেয়েছেন একাধিকবার। লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের জন্য সম্মানিত হয়েছেন। নিজের পরিচালিত আয়নার জন্য পেয়েছেন মেরিল–প্রথম আলো সেরা ছবির পুরস্কার। বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উত্সবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পীদের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছেন। সেন্সর বোর্ডের সদস্য হয়েছেন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বিচারক কিংবা চলচ্চিত্র অনুদান কমিটির সদস্যও হয়েছেন। কিন্তু সফল অভিনয়শিল্পী কবরীর ব্যক্তিজীবনের অপ্রাপ্তি যেমন তাঁকে আজীবন অসুখী করে রেখেছিল, তেমনি রাষ্ট্রের তরফ থেকেও কম বঞ্চনার শিকার হননি তিনি। এ কথা যুগপৎ বিস্ময় ও বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে নানাভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে ঋদ্ধ করেছেন যিনি, তাঁর ভাগ্যে জোটেনি একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদকের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। অসীম অতৃপ্তির মাঝে এইটুকু শুধু সান্ত্বনা—শিল্পী ও শিল্প বেঁচে থাকে মানুষের ভালোবাসায়, এ দেশের চলচ্চিত্রামোদী মানুষ কবরীকে তা দিয়েছে দুহাত ভরে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী কথাসাহিত্যিক; সাংবাদিক