স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল মনোয়ারাকে পা গলাতে হয় পালকির চৌহদ্দির সরু দরজায়। সহপাঠীরা যখন পরবর্তী পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছিল, মনোয়ারা তখন জীবনের কঠিনতম অধ্যায়ের প্রিপারেশনবিহীন পরীক্ষার মুখোমুখি। গ্রামীণ গৃহস্থ একান্নবর্তী পরিবারের ঘানি টানতে টানতেই এগিয়ে চলে তাঁর সংসারজীবনের পথচলা। কৈশোরের উচ্ছ্বলতা যেন এখানে এসে দম আটকে মারা যায়।
সময়ের পরিক্রমায় দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে তিনি ওপরওয়ালার কাছ থেকে যাকে উপহার পেয়েছেন, সেই ছেলেটার জাগতিক ডাকনাম রাখা হয় জহির। আতুড়ঘর থেকেই চরম অনিশ্চয়তাময় এক জীবন নিয়ে জহিরের বেড়ে ওঠা। বাড়ির মুরব্বি মহলের অনেকেই যখন ধরে নিয়েছিলেন যে ছেলেটা টিকবে না, অনেকটা যমের সঙ্গে লড়েই যেন মনোয়ারা জহিরকে টিকিয়ে নেয়; আর এ লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি সমর্থন আসে তাঁর মায়ের কাছে থেকে।
জহিরের বয়স যখন এক বছরও পেরোয়নি, মনোয়ারা ভীষণ অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। মাস দু–একের এ অসুখে ভুগতে ভুগতে কোনো এক ভরদুপুরে ঘরের মেঝেতে পাতা মাদুরে শুয়ে থাকা মনোয়ারা মায়ের কাছে ফ্যালফ্যালিয়ে আকুতি জানায় তার বুকের সন্তানটিকে যেন দত্তক বা পালক দিয়ে দেওয়া হয়। নিজের জীবনের কোনো ঠিকঠিকানা নেই, সন্তান সামলাবে কী করে! ভাগ্যের কি লীলাখেলা; ঠিক সে সময়েই কথা বলতে না জানা শিশুটি ‘মা’ বলে কুঁকিয়ে ওঠে। মনোয়ারা আর তাঁর মা দুজনেই তারস্বরে চেঁচাতে থাকা জহিরের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। মনোয়ারার সে ফুঁপানো কান্না একসময় হাউমাউ কান্নায় রূপ নেয়। ঘরের মধ্যে থাকা তিনটি প্রাণীই যখন গোংরানো, ফুঁপানো আর চেঁচানো কান্নায় ঘুরপাক খায়, তখন ওপরওয়ালা বোধ হয় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তাই তো সেদিন থেকেই মনোয়ারার রোগমুক্তি শুরু হয়। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। আর জহিরকেও কারও দত্তক সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠতে হয়নি।
ছোট্ট জহির আস্তে আস্তে হাঁটতে, কথা বলতে, দৌড়াতে শিখে যায় একসময়। সারা দিনের ডানপিটেপনার শেষে সাঁজের বেলায় কেরোসিন বাতির এক প্রান্তে বসে যখন অন্য প্রান্তের মনোয়ারাকে উদ্দেশ করে বলত, ‘মা, এ বাতির আনোটায় (পড়ুন আলোটায়) তোমারে অনেক সুন্নর (সুন্দর) নাকছে (লাগছে)। ’ সন্তানের মুখে এ প্রশংসা শুনে মনোয়ারার সারা দিনের ক্লান্তি কোথায় যেন নিমেষেই হারিয়ে যেত।
ডানপিটে স্বভাবের জন্য জহির সব সময়ই মায়ের কাছে অতিরিক্ত মনোযোগ পেত এবং খুব ছোটবেলা থেকেই এটা সে তার পাওনা মনে করত। তাই তো আজও কেউ যখন অবহেলা বা তাচ্ছিল্যের সুরে জহিরের সঙ্গে কোনো আচরণ করেন, এটা সে মেনে নিতে পারে না।
জহিরের বয়স যখন ছয়-সাত বছর হবে, কোনো এক দুপুর বেলায় নির্জন পুকুরঘাটে বেঁধে রাখা নৌকায় খেলতে গিয়ে পা পিছলে পানিতে পড়ে যায়। ডুবে গিয়ে যখন প্রথমবার ভেসে উঠল, তখনই সে নৌকার এক প্রান্তে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলে। কিন্তু সাঁতার না–জানা এক বালক পানিতে পড়ে যাওয়ার আকস্মিকতায় চিৎকার করতেও ভুলে যায়। ক্রমেই নৌকা থেকে জহিরের হাত আলগা হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু শরীরের সব শক্তি দিয়েও জহির একফোঁটা চিৎকার করতে পারেনি।
উঠোনের কাজ শেষে ঘরের মাদুরে উঁকি দিয়ে জহিরকে না দেখেই মনোয়ারা কোনো এক অদ্ভুত কারণে পুকুরঘাটের দিকেই জহির জহির বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসেন। পুকুরঘাটে দেখতে না পেয়ে যখন অন্য দিকে ছুটে যাবেন বলে ঠিক করেছেন, তখনই তার চোখে পড়ে কেউ নৌকার ওপরে না থাকলেও নৌকাটা নড়ছে এবং পানিতে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে। কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না মনোয়ারার, ঝাঁপ দেন পানিতে। যতক্ষণে নৌকার উল্টা পাশে মনোয়ারা পৌঁছায়, ততক্ষণে জহিরের কচি হাতের নাগাল থেকে নৌকা ছুটে গেছে। জহির একবার ডুবছে আরেকবার ভাসছে। পানির নিচ থেকেই খাবলা দিয়ে মনোয়ারা তার জহিরকে তুলে নেন মাথার ওপরে। তারপরে মনোয়ারার ভয় চেপে যায়। একি করেছে সে, পা দুটি যে তলিয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে। মনোয়ারা নিজেও তো সাঁতার জানে না। এবার বোধ হয় ওপরওয়ালা ডুবন্তপ্রায় এক মা-সন্তানের বাঁচার আকুতিকে অস্বীকার করতে পারেননি।
কোনো রকমে বেঁচে যান মনোয়ারা, বেঁচে যায় জহির; বেঁচে যায় সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা।
মাকে আজ জহির (আমি নিজেই) ভালোবাসা জানায় মায়ের অজান্তেই। আমাদের সম্পর্কটাই এ রকম যে ঘটা করে মাকে ‘আই লাভ ইউ মাম’ বলা হয়ে ওঠেনি কখনো। কিন্তু জীবনের পরতে পরতেই মাকে আমরা ভালোবাসি এবং সে ভালোবাসা অবশ্যই শ্রদ্ধাবনত ভালোবাসা। মায়ের অস্তিত্বজুড়েই আছি আমরা সন্তানেরা। আবার মা–ও আমাদেরকে আগলে রেখে এক সুখী কুটিরের গল্প লিখে চলছেন নিরন্তর।
*দেলোয়ার হোসেন জহির, ব্যাংকার