স্বাস্থ্যখাতে অগ্রযাত্রার ৫০: আজ পর্ব—৪৯

একজন ‘ডাক্তার ভাই’ ও তাঁর দর্শন

গরিবদের চিকিৎসক ছিলেন এড্রিক বেকার। তাঁর বিশ্বাস ছিল, দরিদ্র মানুষেরাই সেবাকেন্দ্র টিকিয়ে রাখবেন।

ডক্টর ব্রাদার: এ র‍্যাডিকেল নিউজিল্যান্ডার ইন বাংলাদেশ নামে একটি বই নিউজিল্যান্ড থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। দেশে তার বাংলা অনুবাদের কাজও চলছে। বইটিতে এমন একজন চিকিৎসকের কথা বলা হয়েছে, যিনি পৃথিবীর অর্ধেক দূরত্ব পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন এই বিশ্বাস নিয়ে যে সব মানুষের সেবা পাওয়ার অধিকার আছে। দরিদ্র মানুষ স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত থাকবে, এটি ওই চিকিৎসকের কাছে ছিল অগ্রহণযোগ্য। এ জন্য তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন বিকল্প স্বাস্থ্যসেবায়। দরিদ্র মানুষের সেবা করবে দরিদ্র মানুষ—এটাই ছিল তাঁর দর্শন। তিনি এড্রিক এস বেকার। টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় তিনি ‘ডাক্তার ভাই’ নামে পরিচিত।

এড্রিক এস বেকারের জন্ম ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে। ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি একাধিক স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশে এসে মেহেরপুরের বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮১ সালে কাজ করেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে। ১৯৮৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেন টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে থানারবাইদ এলাকায় চার্চ অব বাংলাদেশের একটি ক্লিনিকে। ২০০৪-১৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেন মধুপুরের কাইলাকুড়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার এড্রিক বেকারকে নাগরিকত্ব দেয়।

২০১৫ সালে এড্রিক বেকার মারা যান। কাইলাকুড়ী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যে মাটির ঘরে তিনি থাকতেন, সেই ঘরের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনে বিশ্বাসী ছিলেন এড্রিক বেকার। আমৃত্যু তিনি তা চর্চা করেছেন। মাটিতে বসে সহকর্মী বা রোগীদের সঙ্গে খেতেন। চিকিৎসায় নিজের জীবনদর্শন যুক্ত করেছিলেন।

কাইলাকুড়ীতে ৪ একর জমির ওপর এড্রিক বেকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। ডাক্তার বেকার অর্গানাইজেশন ফর ওয়েলবিং নামের সংস্থার একটি প্রকল্প হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক পিজন নংমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডাক্তার ভাইয়ের (এড্রিক বেকার) আদর্শ ও দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েই আমরা এখানে কাজ করি। আমাদের বেতন, থাকা-খাওয়া নিয়ে কারও কোনো অসন্তুষ্টি নেই। এলাকার মানুষের অগাধ আস্থা এই কেন্দ্রের ওপর।’

অনাড়ম্বর আয়োজন

২২টি পৃথক ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এর মধ্যে পাঁচটি ঘর ইটের দেয়ালের, তিনটি ঘর টিনের বেড়ার। বাকি ১৬টি ঘর মাটির দেয়ালের। মাটির কয়েকটি ঘরে রোগী ভর্তি থাকে। যক্ষ্মা, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, কিডনির সমস্যা, ডায়াবেটিস অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের রোগীর জন্য পৃথক পৃথক ঘর। অপুষ্টিতে ভোগা রোগীর জন্য আলাদা মাটির ঘর।

১৩ মার্চ ভর্তি থাকা রোগীদের কয়েকজন প্রথম আলোকে বলেছেন, এখানে চিকিৎসা, ওষুধ ও থাকা-খাওয়া বিনা মূল্যে। প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে একজন করে আত্মীয় বা দর্শনার্থী থাকতে পারেন। তাঁদের থাকা ও খাওয়ার জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় না।

ওই দিন বিকেলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রান্নাঘরে কয়েকজনকে রাতের খাবার তৈরির প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। তাঁদের তিনজন ছিলেন রোগীর আত্মীয়। তাঁরা জানালেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি থাকা রোগীর আত্মীয়রাও প্রতিদিনের খাবার তৈরিতে অংশ নেন। এটাই রীতি। তিন বেলার খাবারে সবজি ও ডালের প্রাধান্য। রোগী, চিকিৎসক, কর্মকর্তা সবার জন্য একই খাবার।

ভ্যানচালক খোকা চন্দ্র বর্মণ ১৪ দিন ধরে এখানে ভর্তি। বাড়ি প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে জামালপুর সদর উপজেলায়। খোকা চন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কিডনির সমস্যা। তিনি বহু বছর থেকে ‘ডাক্তার ভাই’–এর কথা শুনেছেন। এখানে বিনা মূল্যে ভালো চিকিৎসা হয়, তা–ও তিনি জানেন।

চিকিৎসা আলাদা

প্রতিষ্ঠানে ৭৮ জন কাজ করেন। এর মধ্যে সরাসরি স্বাস্থ্যসেবায় জড়িত ৫০ জন। এই ৫০ জনের ৩০ জনই প্যারামেডিক। একজন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক। একজন এমবিবিএস পাস করা ইন্টার্ন চিকিৎসক। আর দুজন আছেন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। করোনা মহামারির শুরুর দিকে তাঁরা দেশে চলে যান। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাঁরা বাংলাদেশে চলে আসবেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কেন্দ্রে মূলত প্রাথমিক সেবা দেওয়া হয়। ভর্তি রেখে সুস্থ করে তোলা সম্ভব এমন সর্বোচ্চ ৪০ জন রোগীকে বিভিন্ন ঘরে রাখা হয়। ২০২১ সালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৪৪ হাজার ৪০২ জন। আর অন্তর্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ১ হাজার ৪০৭ জন। এক বছরে প্রসবপূর্ব সেবা পেয়েছেন ৫৮৩ জন নারী। আর কেন্দ্রে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নিয়েছে ১৬৭টি সন্তান।

মেডিকেল অফিসার মো. রিয়াজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এখন প্রধান প্রবণতা নানা ধরনের পরীক্ষার পর চিকিৎসা দেওয়া। এখানে ৮০ শতাংশ ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস করা হয়। রোগী ও রোগের ইতিহাস জানা হয়, নানা ধরনের শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসাজ্ঞান কাজে লাগিয়ে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বাকি ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা করা হয়। সে ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়।

সহযোগিতার হাত

একটি ঘরের নাম ওষুধঘর, অর্থাৎ সেটি ডিসপেনসারি। ঘরের বারান্দায় একটি টুলের ওপর রাখা একটি মাটির ব্যাংক। তার গায়ে লেখা: দান করুন ডাক্তার ভাইয়ের হাসপাতালের জন্য। এই কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এড্রিক বেকার বিশ্বাস করতেন গরিবদের জন্য এই সেবা অব্যাহত রাখতে গরিবেরা কিছু না কিছু অবদান রাখবে।

২০১২ সালে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় এড্রিক বেকার তাঁর স্বাস্থ্যসেবা কৌশলের দুটি দুর্বল দিকের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কেন্দ্র চালাতে বাইরের আর্থিক সহায়তা দরকার। আর দরকার এক-দুজন আবাসিক চিকিৎসক। তিনি বলেছিলেন, এই কেন্দ্রে কাজ করতে হলে চিকিৎসকদের বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তাদের মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা একজন–দুজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে এখানে নিয়মিত পাঠায়। ইন্টার্নরা এখানে এসে মাটির ঘরে থাকেন। বারডেম হাসপাতাল সহযোগিতা করছে ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসায়। এ ছাড়া আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

মৃত্যুর এক বছর আগে বাংলাতে ‘সাধারণ রোগের চিকিৎসা বই’ নামে একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছিলেন এড্রিক বেকার। স্বাস্থ্যসেবার উদ্দেশ্য কী, তা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লেখেন, একটা যত্নশীল সমাজ গড়ে তোলা, যা নিজের সদস্যদের স্বাস্থ্যের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে রোগ কম হয় এবং রোগীদের যত্ন করা হয়।