সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ

একজন অন্তর্মুখী মানুষের কথা

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আজ শনিবার সকালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। দেশের ক্রান্তিলগ্নে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তখন দেশের সর্বোচ্চ পদে ১০ মাসের দায়িত্ব পালনকালে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে গড়ে তোলার চেষ্টাই ছিল তাঁর সব কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ছাড়ার সময় ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর ‘বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ: একজন অন্তর্মুখী মানুষের কথা’ শিরোনামে একটি লেখা আজকের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। লিখেছিলেন মতিউর রহমান

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পদের অধিকারী হয়ে, রাষ্ট্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা পেয়ে, সেই পদ এবং ক্ষমতাকে মহিমান্বিত করে তিনি পূর্বপদে, প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাবেন। এ রকমই হওয়ার কথা ছিল। জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে সে কথাই তাঁকে দিয়েছিল। সে অঙ্গীকার পূরণের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে তিনি পূর্ণ সময় পর্যন্ত থাকবেন, নাকি ছেড়ে দেবেন, সেটা একান্তভাবেই তাঁর বিবেচনার বিষয়। তবে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায়, তিনি যথার্থ সিদ্ধান্তই নেবেন। এখন তাঁর বিদায় নেওয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বরেণ্য গবেষক, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ

এভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নায়ক, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, বিদায় নেবেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কর্মভার থেকে। তাঁর বিদায় সংবর্ধনার জন্য কোনো বড় জনসভা বা গণসমাবেশ হবে না। শত শত বাস-ট্রাকে লোকসমাগম দেখা যাবে না। কোনো ফুলের মালা বা বর্ণাঢ্য কোনো অনুষ্ঠানের আওয়াজ শোনা যাবে না। তবু নিশ্চিত বলা যায়, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের বিদায়ের দিনে কিংবা তাঁর পরবর্তী সময়েও দেশের সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবে নিঃশব্দে। নতুন করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি তৈরি কাজে তাঁর নির্দলীয়–নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য তাঁকে অভিবাদন জানাবে। তাঁর জন্য শুভকামনা করবে। আন্তরিকভাবে। এসবই হবে তাঁর সাফল্য বিচারের সবচেয়ে বড় মাপকাঠি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের বিদায় পর্বে বা তারপরেও হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির প্রচেষ্টা নেওয়া হবে, কেউ কেউ তাঁর নিরপেক্ষ অবস্থানের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করতে উদ্যোগী হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই কোনো কোনো মহল থেকে সে চেষ্টা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন পর দেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর মুখ্য ভূমিকা ক্রমশ আরও সমুজ্জ্বল হবে। তাঁর স্বীকৃতি কমবে না, বরং বাড়বে। দেশে-বিদেশে যখন সাবেক শাসকের দুর্নীতি, অনাচার এবং অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম বাংলাদেশের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে, তখন তার পাশাপাশি আরেকজন, রাষ্ট্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ভূমিকা বাংলাদেশের নতুন এক পরিচয়, নব অবয়ব দান করেছে। দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি সকলের আস্থা বেড়েছে। জাতিকে এই বিরল সম্মান প্রদানের কৃতিত্বের বহুলাংশের দাবিদার নিঃসন্দেহে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।

দেশের ক্রান্তিলগ্নে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ

এসব কৃতিত্বের পরও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ থেকেছেন নিজের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে। বলা যায়, সবার অলক্ষ্যে থেকে তাঁর সকল দায়িত্ব তিনি সম্পন্ন করেছেন দৃঢ়ভাবেই। আসলে তিনি একজন অন্তর্মুখী মানুষ। সে জন্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যাপারে তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও তাঁর আচরণে, তাঁর দায়িত্ব পালনের মধ্যে এর কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। দেশের মানুষের সমর্থিত তিন জোটের ঘোষণা অনুযায়ী দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রদত্ত সকল অঙ্গীকার পূরণ করেছেন একনিষ্ঠভাবে, অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সকল মোহের ঊর্ধ্বে থেকেছেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বা প্রয়োজন ছাড়া রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনে আসেননি। প্রতিদিনের কার্যক্রমের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কাছ থেকে সুবিধা নেননি। রাষ্ট্রপতির জন্য নির্ধারিত অন্য কোনো কিছু তিনি গ্রহণ করেননি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বিদেশে অবস্থানরত পুত্রের সঙ্গে টেলিফোন-কথোপকথনের সতের শ টাকার বিল তিনি নিজে দিয়েছেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তৃতা বা অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও ক্যাসেট করিয়ে তার খরচ দিতে না পারলেও (এমন কোনো নিয়ম নেই বলে) একটি নতুন ভিডিও ক্যাসেট দিয়েছেন বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে। বিদেশি অতিথিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার সরকারি তোষাখানায় জমা দিয়েছেন নিয়ম অনুযায়ী। এসবই আমাদের দেশের যেকোনো স্তরের একজন ক্ষমতাসীন ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া দুর্লভ। অতিশয় সাধারণ পোশাক-পরিচ্ছদই তাঁর পছন্দ। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকেই তাঁকে নতুন কিছু জামাকাপড় বা স্যুট তৈরির কথা বলেছিলেন। সেসব কথাকে তিনি আমল দেননি। সময়ানুবর্তিতার ব্যাপারে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল সব সময়। প্রতিদিন সকালে দৈনিক পত্রিকা পড়ার মধ্য দিয়ে দিনের কাজ শুরু হয় তাঁর। ঠিক সময়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে উপস্থিত হয়েছেন প্রতিদিন, ব্যতিক্রমহীনভাবে। কখনো কোনো ফাইল তাঁর টেবিলে পড়ে থাকেনি। অবসর সময়ে তাঁর নেশা বই পড়া। এখন তিনি পড়ছেন চার্চিলের আত্মজীবনী।

সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও সাবেক বিচারপতি হাবিবুর রহমান

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের আরেকটি দিকও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্রপ্রধানের স্ত্রী, পারিবারিক সদস্য বা আত্মীয়স্বজনের যে দোর্দণ্ড প্রভাব ও হস্তক্ষেপ দেখা গেছে রাষ্ট্রের নানা বিষয়ে, সেখানে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের ক্ষেত্রে এর এক কণা দেখা দূরের কথা, এ রকম কোনো কিছু শোনাও যায়নি। তাঁর স্ত্রী একবারের জন্যও বঙ্গভবনে আসেননি। রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানেও তাঁকে দেখা যায়নি। থেকেছেন নিভৃতে, পরিবারের মধ্যে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সন্তান-সন্তানাদির কোনো কথা শোনা যায়নি। কারও জন্য ছিল না কোনো বিশেষ সুবিধা। তাঁর বাসভবনে কোনো আত্মীয়স্বজনের আসা-যাওয়া ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। বিচারপতিদের সাধারণত বেশ কিছুটা বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় সমাজ থেকে। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তার চেয়েও বেশি সতর্ক ছিলেন। এসবই তিনি করেছেন রাষ্ট্রীয় নেতাদের জীবনযাপনের একটি নির্দিষ্ট মান তৈরির জন্য এবং সেখানেও তিনি সফল হয়েছেন।

আসলে বাংলাদেশের মতো একটি অত্যন্ত গরিব দেশ, যেখানে জনসংখ্যার শতাংশের বেশি মানুষের জীবনযাপনের মান দারিদ্র্যসীমার নিচে, সেখানে রাষ্ট্রীয় নেতাদের চাকচিক্য আর বিলাসী জীবন অত্যন্ত দৃষ্টিকটু, কোনো কোনো সময়ে তা ভয়ংকরভাবে কদর্য। কিন্তু অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির জীবনযাপন আর আচরণ ছিল আদর্শস্থানীয়, সকলের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহকারীর মন্তব্য হলো, এটা আমাদের সৌভাগ্য যে জাতির একটি অত্যন্ত সংকটজনক সময়ে আমরা সকল দিক থেকে একজন আদর্শস্থানীয় মানুষকে পেয়েছিলাম। সহজ–সরল একজন সাধারণ মানুষ তিনি। কিন্তু দেশ ও জাতির প্রয়োজনের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর ছিল অসাধারণ সাহস। সেটাই আমরা দেখেছি বিভিন্ন কঠিন সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে।

১০ মাসের শাসনামলে দেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে গড়ে তোলাই ছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সকল কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য। এই দুরূহ–দুঃসাধ্য কাজটি তিনি করেছেন। তিনি অত্যন্ত জটিল রাজনৈতিক একটি প্রক্রিয়াকে অগ্রসর করে নিতে নিরলসভাবে সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে নানা দল তাঁকে ভুল বুঝেছে, সরকার ও বিরোধী দল—উভয়েই সমালোচনা করেছে, অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কিন্তু যখন দেশ কোনো রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়েছে, তখন তিনি দেশবাসীর সামনে সে বিষয়ে খোলামেলা বলে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, সেগুলো সমাধান করতে সাহায্য করেছেন। শেষ বিচারে প্রায় সকলেই তা মেনে নিয়েছেন। এভাবেই যেকোনো মানদণ্ডে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষতার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিরপেক্ষ থাকা কঠিন যে দেশে, সেখানে সকল রকম দলাদলির ঊর্ধ্বে থেকে প্রায় নিখুঁতভাবে দেশ পরিচালনা করেছেন তিনি।

মাত্র ১০ মাসে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তাঁর ওপর অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের এখন বিদায় নেওয়ার পালা। নতুন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি চলে যাবেন তাঁর পূর্বপদে। আমরা নিশ্চিত, তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে যাচ্ছেন সেখানে। কারণ, তিনি তাঁর ওপর অর্পিত কর্তব্য সম্পাদন করেছেন, তাঁর কথার কোনো নড়চড় হয়নি। কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি তাঁর ভাবনায়। কখনো কখনো তাঁকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা নেওয়া হলেও তিনি সেসব কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি চলেছেন তাঁর স্থির নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। ক্ষমতার মোহ তাঁকে আকৃষ্ট করেনি, তাঁকে ছুঁতে পারেনি। আমাদের দেশের জন্য এটা সত্যি বিস্ময়কর।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ চলে যাবেন, তিনি নিঃশব্দে চলে যাবেন—এটাই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সেটাই তাঁর কাম্য। কিন্তু যাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি অত্যন্ত কঠিন দায়িত্ব তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, সেই শক্তিগুলো, তিনটি রাজনৈতিক জোট, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং আন্দোলনকারী সকল শক্তির কি এখন কিছুই করণীয় নেই? তারা কি সকলে মিলিত বা যুগপৎভাবে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য একটি অত্যন্ত সাধারণ অনুষ্ঠান বা অন্য কোনো কিছু একটা করতে পারে না? একজন অন্তর্মুখী মানুষ, একজন বিচারপতি, যাঁর হাতে একদিন রাষ্ট্র পরিচালনার এক কঠিন দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন কি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? এটা করতে না পারলে, আমরা একজন ছোট দেহাকৃতির সরল মানুষের কাছে, সকলে মিলিতভাবে অত্যন্ত সংকীর্ণ আর ক্ষুদ্র হয়ে যাব।

আজকের কাগজ, ১০ অক্টোবর ১৯৯১