রবীন্দ্রনাথ-নজরুল; একটি অপবিত্র তুলনা
কলকাতার ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার আগস্ট, ১৯৮৬ সংখ্যায় প্রকাশিত ড. আহমদ শরীফের একটি লেখার জবাব দিতে গিয়ে গবেষক-কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ বলছেন, ‘তুলনা যদি কাউকে ছোট করার জন্য, এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের, তখন ব্যাপারটা অশ্লীল ও অরুচিকর হয়ে ওঠে। সাহিত্যে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, প্রত্যেকে তাঁর স্বাতন্ত্রিকতায় চিহ্নিত। সুকান্ত একুশ বছর বয়সে কবি জীবন সমাপ্ত করেছেন—ওই বয়সে রবীন্দ্রনাথ সদ্য-উন্মীলিত। লোরকার আটতিরিশ-উনচল্লিশ বছর বয়সে জীবন ও কবিজীবন শেষ হয়েছে—ওই বয়সে রবীন্দ্রনাথ কতখানি রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ ক্রমপরিণত, নজরুলের উন্মীলন ও নিমীলন দুই-ই দ্রুত। উদ্দাম ও বিদ্যুচ্চকিত।’
শ্রদ্ধা ও স্নেহমণ্ডিত দুই মহামানবের সম্পর্ক ছিল প্রকৃত অর্থে অপার্থিব সৌন্দর্যের আধার। দুজনের লেখনীতে, জীবনীতে, কর্মকাণ্ডে একে অপরের জন্য সম্মান, স্নেহ ও গভীর ভালোবাসা ছাড়া আর অন্য কিছু কোনো দিন তাঁদের সবচেয়ে বড় শত্রুও খুঁজে বের করতে পারেননি। তাঁরা দুজনই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তাঁদের মধ্যে একটি ঈর্ষণীয় মধুর গুরু-শিষ্য সম্পর্ক থেকেও কেউ কারও রচনার ধারায় বিন্দুমাত্র প্রবেশ করতে পারেননি। নিজেদের সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁরা দুজনই অনন্য স্বকীয়।
যেখানে বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব ত্রিশের দশকের বিশিষ্ট পাঁচজন কবি—অবুজবিসু (অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত) রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে গিয়ে বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতা সৃষ্টির জন্য রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, সেখানে কবি নজরুল গুরু হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করেও নিজের রচনার ক্ষেত্রে ছিলেন রবি বলয় থেকে পূর্ণাঙ্গ মুক্ত একজন কবি, সে এক অতুল প্রতিভা।
নজরুলের সাহিত্যকে তুলনা করা হয় বিদ্রোহী ব্রিটিশ কবি লর্ড বায়রনের সঙ্গে। বুদ্ধদেব বসু নজরুল-সম্পর্কিত লেখায় তাঁর কাব্যধারাকে তুলনা করেছেন রুডইয়ার্ড কিপলিঙের সঙ্গে। অথচ কখনো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে কেউই বায়রন অথবা কিপলিঙের সঙ্গে তুলনা করেননি।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক দর্শন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে, আরও হবে। তাঁর কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তিকে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন মহাশক্তির প্রেরণা। তিনি বলতেন, কেউ তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছে। ‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ভগবানের আনন্দ সৃষ্টি আপনার মধ্য হইতে আপনি উত্সারিত; মানবহৃদয়ের আনন্দ সৃষ্টি তাহারই প্রতিধ্বনি। এই জগত্সৃষ্টির আনন্দ গীতের ঝংকার আমাদের হৃদয় বীণাতন্ত্রীকে অহরহ স্পন্দিত করিতেছে; সেই-যে মানস সংগীত, স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতিঘাতে আমাদের অন্তরের মধ্যে সেই-যে সৃষ্টির আবেগ, সাহিত্য তাহারই বিকাশ।’
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রকাব্য পুরোটা আধ্যাত্মিকতা ও ভাবের মিশ্রণ। কেউ কেউ বাউল কবি লালন শাহর প্রতিরূপ দেখতে পান রবীন্দ্রকাব্যের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৩ সালে লন্ডনে তাঁর বক্তৃতামালায় লালন শাহকে একজন ‘আধ্যাত্মিক কবি’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘তিনিই “আত্মা”কে আবিষ্কার করেছেন এবং “মানুষ”-এর অর্থ খুঁজে পেয়েছেন।’ বিশ্ব সৃষ্টির গৌরবোজ্জ্বল বেয়ে চলা রবির বিভিন্ন রচনায় ঘুরেফিরে এসেছে। ‘গীতাঞ্জলি’র ভাববাদ ইউরোপীয় কবিদের একসময় আলোড়িত করেছিল। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের ভেতর খুঁজে পেয়েছিলেন ঐশ্বরিক প্রচ্ছায়া। রবীন্দ্র গবেষক আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে বলছেন, এই ‘ভাববাদ’কেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘আধুনিকতা’, তাঁর ভাষায় আধুনিকতা ‘কালের কথা ততটা নয়, যতটা ভাবের কথা।’
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাঁর ভাববাদী চেতনা স্বতঃসিদ্ধভাবেই এসে যায়। নজরুল ভাববাদী দর্শনের কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন সমাজ সংগঠক ও দ্রোহের কবি। ব্রিটিশ তাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে তিনি তাঁর গানে, কবিতায় তোলপাড় করেছেন সমাজকে, মানুষের অবচেতনের সুপ্ত জগৎকে। রবীন্দ্রনাথ যখন জীবনের ৬০ বছর অতিক্রম করেছেন, নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়ে গেছেন, তখন নজরুল সবে কলম ধরেছেন। এই দুই কবির মধ্যে তাই তুলনা করাটা রীতিমতো অযৌক্তিক, অপাঙ্ক্তেয়, অশ্লীল এবং হাস্যকরও বটে।
নজরুল-রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতই কবি ছিলেন। তাই তাঁরা মানবতার দর্শনকেই লালনপালন করে আমাদের পথও দেখিয়েছেন। নেওয়া না-নেওয়া সেটা আপনার-আমার ব্যাপার, কিন্তু কিছু মিথ্যাকে পুঁজি করে তার ওপর বেসাতি নিশ্চয়ই সমাজের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না।
*মেহেদী হাসান তামিম: লেখক, গল্পকার