হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কবির হোসেনের পাশে তাঁর স্ত্রী খাদিজা আক্তার
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কবির হোসেনের পাশে তাঁর স্ত্রী খাদিজা আক্তার

এই সংসার চলবে কী করে: লঞ্চের ধাক্কায় পা হারানো কবিরের স্ত্রী

রাজধানীর নবাবপুরে বৈদ্যুতিক পাখার দোকানে দিনমজুরের কাজ করতেন কবির হোসেন (২৮)। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করতে স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে পটুয়াখালীতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সদরঘাটে লঞ্চের ধাক্কায় গুরুতর আহত হলেন এই যুবক। কেটে ফেলতে হলো বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ। পুরো পরিবারের জন্য ঈদ উদ্‌যাপন পরিণত হলো চরম বিষাদে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে চিকিৎসাধীন কবিরের এখন একমাত্র চিন্তা কীভাবে চলবে সংসার, একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ দেখবে কে?

ঈদুল ফিতরের এক দিন আগে ১ মে সকালে স্ত্রী, মেয়েকে ও তিন বোনকে নিয়ে সদরঘাটে আসেন কবির হোসেন। ঘাটে পটুয়াখালীর একটি লঞ্চ থাকলেও সেটি কানায় কানায় ভরা থাকায় স্বজনদের নিয়ে লঞ্চে উঠতে পারেননি তিনি। অপেক্ষার পর পূবালী-১২ লঞ্চটি ঘাটে ভিড়তে শুরু করে। বেশি গতি থাকায় এটি পন্টুনে এসে জোরে ধাক্কা দেয়। অন্যদিকে যাত্রীর প্রচণ্ড চাপ পন্টুনে। এ সময় লঞ্চ ও পন্টুনের মাঝে চাপ খেয়ে কবির হোসেনের বাঁ পা হাঁটুর নিচ থেকে প্রায় আলাদা হয়ে যায়। আর শাহজালাল নামে আরেক ব্যক্তির ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে ভেঙে যায়। পরে তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

আজ বুধবার রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কবির হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ওই দিন ঘাটে এসে শুনলাম অন্য রুটে (নৌপথে) চলাচলকারী লঞ্চের মালিকেরা পটুয়াখালী রুটের বিশেষ ঈদ সার্ভিসে লঞ্চ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যাত্রীর চাপ থাকার পরও সংশ্লিষ্ট রুটের মালিকদের চাপে বেশি লঞ্চ দেয়নি বিআইডব্লিউটিএ। বেশি লঞ্চ থাকলে যাত্রীর চাপ থাকত না। আর যাত্রীর চাপ না থাকলে আজকে আমার জীবনে এত বড় ক্ষতি হতো না।’

যাত্রীদের হুড়োহুড়ির কথা বলে নিজেদের অব্যবস্থাপনার দায় কোনোভাবেই বিআইডব্লিউটিএ এড়াতে পারে না বলে দাবি করেন কবির হোসেন। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনায় জড়িত লঞ্চটির মালিক ম্যানেজারের মাধ্যমে আমার খোঁজখবর নিয়েছেন। নিজে হাসপাতালে আসেননি। এ ছাড়া আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও কোনো আর্থিক সহযোগিতা করা হয়নি।’

চিকিৎসার খরচ কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন জানতে চাইলে কবির হোসেন বলেন, ‘লঞ্চের মালিক প্রথম দিকের চিকিৎসার খরচ দিয়েছেন। কয়েক দিন আগে ম্যানেজার বলেছেন, বিআইডব্লিউটিএ নাকি লঞ্চটির চলাচল বন্ধ রেখেছে। লঞ্চ বন্ধ থাকলে তাদের পক্ষে খরচ বহন করা কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।’

সুস্থ হওয়ার পর লঞ্চের মালিক কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিলেও তা নিয়ে সংশয় রয়েছে কবির হোসেনের। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েটার জন্য আমাকে কিছু করতে হবে। তাঁরা (লঞ্চ কর্তৃপক্ষ) বলেছে, আমাকে লঞ্চে একটা চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু পা তো নাই, কী চাকরি করব? কিছু টাকা পেলে নিজের গ্রামে একটি দোকান দিতে পারতাম, বসে ব্যবসা করা যেত।’

সুস্থ হওয়ার পর বিআইডব্লিউটিএ থেকে আর্থিক সহায়তা পেতে আবেদন করবেন বলে জানান কবির হোসেন।

সুস্থ হলে গ্রামে গিয়ে দোকান করতে চান কবির হোসেন

হাসপাতালে কবির হোসেনের দেখাশোনা করছেন তাঁর স্ত্রী খাদিজা আক্তার (পারুল)। নিজেদের আর্থিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। খাদিজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কেউ নাই। যদি সহযোগিতা না পাই সংসার চালানোর কোনো উপায় আমাদের নাই। আমাদের মেয়েটার ভবিষ্যতের কী হবে জানি না। এই সংসার চলবে কী করে?’

নৌ দুর্ঘটনার শিকার যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের একটি নৌ দুর্যোগ তহবিল ট্রাস্টি বোর্ড রয়েছে। আহত কবির হোসেন এই তহবিল থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন কি না বা সরকারের পক্ষ থেকে যাত্রীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন ২ মে করা হয়েছিল বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেককে। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘সব চিকিৎসার দায়িত্ব লঞ্চমালিক নিয়েছেন। আমরা অবশ্যই প্রয়োজনীয় সাহায্য করব।’