বিশাল একটি বটগাছ। পাশেই ছোট দুটি পাকা ঘর। ওপরে টিনের ছাউনি। ঘর দুটি পাশাপাশি। ঠিক মধ্যে দুটি শৌচাগার। ঘর দুটির সামনে দুটি ছোট্ট রান্নাঘর। ঘর দুটিতে রয়েছে বৈদ্যুতিক সংযোগ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ভোট দেওয়ার অপরাধে’ ধর্ষণের শিকার দুই নারীর জন্য ঘর দুটি তৈরি করে দিয়েছে সরকার। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল গ্রামের ঋষিপল্লির এই ঘর দুটিতে বসবাস করে দুটি পরিবার।
৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে ওই দুই নারী ভোট দিতে যাননি। তারপরও ‘ভোট দেওয়ার অপরাধে’ ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে তাঁদের বাড়িতে হামলা হয়। গণধর্ষণের শিকার হন দুই নারী। সম্পর্কে তাঁরা ননদ-ভাবি। ঘটনার পর অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। বাড়িতে ফিরে এসেছেন একজন। অপরজন এখনো বাড়ি ফেরেননি।
গত মঙ্গলবার হাজরাইল গ্রামের ঋষিপল্লিতে যান এই প্রতিবেদক। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বয়সী মানুষের কথা হয়। তাঁদের কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। অধিকাংশই বলেছেন, তাঁরা ভালো নেই। ভয়ে আছেন। নির্বাচন সামনে রেখে ধর্ষকদের অন্তত তিনজনের পল্লিতে আনাগোনা বেড়েছে। এ কারণে তাঁদের ভয় বেড়েছে। তাঁরা জানান, এখন পর্যন্ত পল্লিতে কোনো প্রার্থী ভোট চাইতে আসেননি। নির্বাচনের কারণে পল্লির বেশ কয়েকজন অন্যত্র চলে গেছেন। নির্বাচনের পর পরিবেশ ভালো হলে তবেই ফিরবেন। যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই নির্বাচনে ভোট দিতে যাবেন না। একজন বাদে আসামিদের সবাই এখন জামিনে আছেন। তাঁরা প্রায় প্রতিদিন পল্লিতে এসে পল্লির কিছু লোকের সঙ্গে আড্ডা দেন। তাস খেলেন। নানাভাবে হুমকি-ধমকিও দেন।
পল্লির একজন বলেন, ‘এখনো রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। কোনো কিছুর শব্দ হলে বুকটা কেঁপে ওঠে। সামনে নির্বাচন। খুব ভয়ে আছি।’ অপর একজন বলেন, ‘আসামিদের সঙ্গে পল্লির কিছু লোকের খুব খাতির। ঘটনার আগে এই আসামিরা ওই লোকদের সঙ্গে পাড়ার দোকানে নিয়মিত আড্ডা দিত ও তাস খেলত। জামিনে বেরিয়ে এসে তারা আবার আগের মতো পাড়ায় আড্ডা দেয়।’ ঋষিরা মূলত চামড়ার কাজ করেন। এ ছাড়া তাঁরা বাঁশ ও বেত দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। ঋষিরা প্রধানত হিন্দুধর্মাবলম্বী। হাজরাইল গ্রামের ঋষিপল্লিতে ৯০টি পরিবারে প্রায় ৬০০ লোকের বসবাস। তাঁদের মধ্যে ভোটার প্রায় ৪০০। তাঁরা ভোট দেবেন পল্লি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাটাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ‘ভোট দেওয়ার অপরাধে’ ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল গ্রামের ঋষিপল্লিতে হানা দেয়। তারা দুটি পরিবারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। এ সময় তাদের গণধর্ষণের শিকার হন দুই নারী। ১০ জানুয়ারি ওই দুই নারী সাত-আটজন অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মনিরামপুর থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন। এরপর পুলিশ উপজেলার ভোমরদহ গ্রামের মফিজ গাজী, একই গ্রামের সাহাবুদ্দীন হোসেন ওরফে সিহাব ও সিদ্দিকুর রহমান এবং ঋষিপল্লির উত্তম দাসকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে মফিজ গাজী, সাহাবুদ্দীন হোসেন ওরফে সিহাব এবং সিদ্দিকুর রহমান নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এর মধ্যে মফিজ ও সিহাব ধর্ষণের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। তাঁদের স্বীকারোক্তিতে নাম আসে ভোমরদহ গ্রামের সাইফুল ইসলাম, একই গ্রামের সোহরাব হোসেন, রেজাউল ইসলাম, মো. আলীম, মো. ইলিয়াস ও মো. আবু তাহেরের। এরপর ওই বছরের ২৫ এপ্রিল মামলা দুটি যশোর অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়। যশোর সিআইডির পরিদর্শক মো. হুমায়ুন কবীর ও মোহাম্মদ শাহজান খান মামলা দুটি তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। মামলা দুটিতে অভিযুক্ত আসামি ২০ জন। আসামিদের সবাই বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থক এবং ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ায় তাঁরা এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটান বলে অভিযোগপত্র দুটিতে উল্লেখ করা হয়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মাহমুদুল হাসান বলেন, গত সংসদ নির্বাচনের সময় হাজরাইল ঋষিপল্লিতে একটা ঘটনা ঘটেছিল। এখন সেখানে কোনো আতঙ্ক নেই। ঋষিপল্লির মানুষ এবার নির্ভয়ে ভোট দিতে যাবেন।
মনিরামপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এস এম এনামুল হক বলেন, হাজরাইল গ্রামের ঋষিপল্লিসহ মনিরামপুর উপজেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। এখন আতঙ্কিত হওয়ার তেমন পরিস্থিতি নেই। সুতরাং নির্বাচন সামনে রেখে তাদের অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ারও কিছু নেই।