উল্টো কমেছে বেসরকারি গ্রন্থাগারের অনুদান

বেসরকারি গ্রন্থাগারের উদ্যোক্তাদের ক্ষোভ। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বলছে, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন

পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি ও জনগণকে গ্রন্থাগারমুখী করতে সরকারি গণগ্রন্থাগারের পাশাপাশি কাজ করে বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো। এই গ্রন্থাগারগুলোর জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু এই বরাদ্দ তো বাড়েনি, গত অর্থবছরে গ্রন্থাগারগুলোর অনুদান আরও কমেছে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বেসরকারি গ্রন্থাগারের উদ্যোক্তারা।

দেশে বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র।

গ্রন্থকেন্দ্র সূত্র জানায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারা দেশে ৮৫০টি বেসরকারি গ্রন্থাগারকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়। ক শ্রেণির একটি গ্রন্থাগার ৬০ হাজার টাকা, খ শ্রেণির গ্রন্থাগার ৪৯ হাজার টাকা এবং গ শ্রেণির গ্রন্থাগার ৪২ হাজার টাকা করে অনুদান পায়। অনুদানের অর্ধেক নগদ ও অর্ধেক টাকার বই দেওয়া হয়।

একই সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে (২০২০-২১) অনুদান দেওয়া হয় ১ হাজার ১০টি গ্রন্থাগারকে। কিন্তু অনুদানের পরিমাণ ছিল সেই সাড়ে ৪ কোটি টাকা। এতে গ্রন্থাগারগুলো আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে কম বরাদ্দ পেয়েছে। ক শ্রেণির একটি গ্রন্থাগার পেয়েছে ৪ হাজার টাকা কম, ৫৬ হাজার টাকা; খ শ্রেণির গ্রন্থাগার পেয়েছে ৩ হাজার টাকা কম, ৪৬ হাজার টাকা; গ শ্রেণির গ্রন্থাগার পেয়েছে ৬ হাজার টাকা কম, ৩৬ হাজার টাকা।

গ্রন্থাগারকে নানাভাবে গড়ে তোলার জন্য যা কিছু দরকার, তা সঠিকভাবে দিতে হবে। এটা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দর্শনের জায়গা। রাষ্ট্র যেন এ জায়গাটি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, সে জন্য অনুদান সঠিকভাবে দেওয়া প্রয়োজন।
সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যিক

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দেশের বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে নিয়মিত অনুদানের পাশাপাশি এককালীন অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বেসরকারি গ্রন্থাগারের সংগঠকেরা জানিয়েছেন, বাস্তবে কোনো গ্রন্থাগারই এককালীন অনুদান পায়নি।

গ্রন্থাগার পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ভাষ্য, ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্রন্থাগারিকের বেতনসহ একটি গ্রন্থাগার পরিচালনার ন্যূনতম ব্যয় ঢাকায় মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। ঢাকার বাইরে জেলা বা উপজেলা সদরে তা ১৫ হাজার টাকার কম নয়। কিন্তু জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা একটি গ্রন্থাগারের দুই মাসের ব্যয়ও হয় না। বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর উদ্যোক্তারা গ্রন্থাগারিকের বেতনটা সরকারিভাবে দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি।

ঢাকার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দনিয়া পাঠাগারের প্রধান মো. শাহনেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র দেশের ১০০টি গ্রন্থাগারে বঙ্গবন্ধুর বইয়ের পাঠ কার্যক্রম, সারা দেশে বইমেলার আয়োজন, দেশের বাইরে ফ্রাঙ্কফুর্ট ও নিউইয়র্ক বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছে। এই কাজগুলোকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার মূল কাজটিতে তারা পিছিয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে বলার পরেও গ্রন্থাগারগুলোর জন্য তারা বরাদ্দ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারেনি। দেশে পাঠাগারচর্চার পৃষ্ঠপোষকতায় এটি একটি দুর্বল দিক।’

তাঁর এ বক্তব্যের বিষয়ে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, কিছু নিষ্ক্রিয় গ্রন্থাগার রয়েছে, যারা অনুদান নেয়, কিন্তু কার্যক্রম করে না বললেই চলে। এগুলোকে চিহ্নিত করে বরাদ্দ বাতিল করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এটা করা গেলে সক্রিয় গ্রন্থাগারগুলোর বরাদ্দ বেড়ে যাবে। তা ছাড়া তাঁরা বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মতে, বেসরকারি গ্রন্থাগারের বরাদ্দ অবশ্যই বাড়ানো দরকার।

রাজধানীর পল্লীমা সংসদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগার। এই গ্রন্থাগারের সম্পাদক আনিসুল হোসেন (তারেক) বলেন, দেশে অনেক গ্রন্থাগার সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের অধীনে পরিচালিত হয়। সংগঠনের চাঁদায় এগুলো চলে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের অনুদানে গ্রন্থাগারের দরজা খোলাও এক প্রকার অসম্ভব। তাঁর মতে, শুধু অনুদান দেওয়া আর বই নেওয়া নয়, গ্রন্থাগারের গুণগত মান উন্নয়নের কাজটিতে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

এমন পরিস্থিতিতে আজ ৫ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার, ডিজিটাল পাঠাগার’। দিবসটি উপলক্ষে আজ বেলা ১১টায় শাহবাগে জাতীয় গণগ্রন্থাগার মিলনায়তনে সীমিত পরিসরে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

জনগণকে গ্রন্থাগারমুখী করা, পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি, মননশীল সমাজ গঠনের কেন্দ্রবিন্দু ও জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গ্রন্থাগারের ভূমিকাকে দৃঢ় করাই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের লক্ষ্য। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি পালন শুরু হয়।

২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেশির ভাগ গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে যায়। ছয় মাস পর সেপ্টেম্বর থেকে ধুলো-ময়লা ঝেড়ে বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো আবার খুলতে শুরু করে। গ্রন্থাগারগুলোর একটি বড় অংশই রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। পাঠক কম।

দেশে সরকারি গণগ্রন্থাগারের সংখ্যা ৭১। বেসরকারি গ্রন্থাগারের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না। তবে এ সংখ্যা ২ হাজারের কাছাকাছি।

অনুদান কমা এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, গ্রন্থাগারকে কোনোভাবে অবহেলা কোনো রাষ্ট্রের দায়িত্ব হতে পারে না। আমরা চাই, গ্রন্থাগার সর্বত্র থাকবে এবং ভালোভাবে থাকবে। প্রজন্মকে নানাভাবে মানবিক চেতনায়, মানসিক সমৃদ্ধিতে পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে শিক্ষাজীবন, সেই শিক্ষাজীবন গ্রন্থাগারের মধ্যেই থাকে। শিশু-কিশোর-তরুণদের মাঝে গ্রন্থাগারের পরিসর বিস্তৃত করে না দিলে তাদের আলোকিত করে তোলা যাবে না। সে জন্য গ্রন্থাগারকে নানাভাবে গড়ে তোলার জন্য যা কিছু দরকার, তা সঠিকভাবে দিতে হবে। এটা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় একটি দর্শনের জায়গা। রাষ্ট্র যেন এ জায়গাটি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, সে জন্য অনুদান সঠিকভাবে দেওয়া প্রয়োজন।