করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত উপসর্গহীন মানুষের উদাসীনতার কারণে অন্যরা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। এর ফলে বেড়ছে সংক্রমণ, বেড়ছে মৃত্যু। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার উপসর্গহীন মানুষদের চিহ্নিত না করা গেলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো কঠিন হবে।
বুধবার থেকে সারা দেশে কঠোর লকডাউন কার্যকরের দিনই করোনায় ৯৬ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। দেশের ইতিহাসে করোনায় ২৪ ঘণ্টায় এত মানুষের মৃত্যু কখনো হয়নি। করোনায় মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার জন্য গেল কয়েক মাস স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাকে দায়ী করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুধবার থেকে কঠোর লকডাউন কার্যকরের প্রভাব পড়বে আরও তিন সপ্তাহ পরে। যে কোনো স্বাস্থ্যগত ব্যবস্থা সংক্রমণের পরিস্থিতি বোঝা যায় দু’সপ্তাহ পরে। কারণ দু’সপ্তাহ হচ্ছে করোনার সুপ্তিকাল। যারা করোনায় সংক্রমিত হয়ে জটিল অবস্থায় আক্রান্ত হয়, করোনায় সংক্রমিত হওয়ার তিন সপ্তাহের মাথায় তারা আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) যায়। বুধবার যে ৯৬ জন মারা গেছেন, যারা তিন সপ্তাহ আগে করোনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন। তখন তো করোনা ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ ছিল না। তখনো যার যার খুশি মতো আচরণ করেছি।’
করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় তা ঠেকাতে সরকার কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, যারা করোনায় সংক্রমিত হয়েও বুঝতে পারেননি করোনা হয়েছে—তারাই অন্যদের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ফেলেছে। সেভাবে উপসর্গ প্রকাশ না হওয়ার কারণে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রেও এই মানুষগুলো ছিল উদাসীন। করোনায় যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগ বয়স্ক ব্যক্তি। অথচ করোনাকালে বয়স্করা তো আর ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। আসলে উপসর্গহীন এই ব্যক্তিরা তাঁর পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল মো. নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষকে বোঝানো যাচ্ছে না যে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে বৃদ্ধদের। মৃত্যুর হারও তাদের বেশি। যিনি বৃদ্ধ তিনি তো ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। তাহলে তিনি কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন? এই জিনিসটা কিন্তু মানুষ বোঝে না। আমরা অনেকে বলি, নিম্ন আয়ের মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ তারা তো সংক্রমিত হচ্ছে না। তাদের মৃত্যুর হার কম। কিন্তু ব্যাপারটা কি তাই? ব্যাপারটা হচ্ছে, যারা খেটে খাওয়া মানুষ, যারা বয়সে তরুণ, তারা করোনায় সংক্রমিত হলেও উপসর্গ থাকে না। তাঁরা বুঝতে পারেন না যে, তারা করোনায় সংক্রমিত। এরা সব থেকে বিপজ্জনক।’
করোনায় মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার জন্য মানুষের অসচেতনতা ও সংক্রমণের শুরুতে অবহেলাকে দায়ী করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক।
কর্নেল নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা রোগীকে সময়মতো অক্সিজেন দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। অক্সিজেন দেওয়ার পরও যখন কিছুতেই কোনো কাজ না হয়, তখন রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অনেকে ভালো হয়ে যাচ্ছেন। অনেকে মারাও যাচ্ছেন। করোনা রোগী আমাদের কাছে এমন সময় আসেন, তখন সর্বাত্মক চেষ্টা করলেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফলটা পাওয়া যায় না। করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর প্রথমদিকে যদি রোগী হাসপাতালে আসেন, তাহলে কিন্তু অনেক ভালো হয়।’
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আছে দেশের অন্যতম বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বর্তমানে এই হাসপাতালে ৭৫০ জন করোনা রোগী ভর্তি আছেন।
মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আক্ষেপের সুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘মানুষজন করোনায় আক্রান্ত হলেও তারা বিশ্বাস করতে চান না যে, তার করোনা হয়েছে। ফলে প্রথমদিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন না তাঁরা। একপর্যায়ে শারীরিক পরিস্থিতি যখন খারাপ হয়ে আসে, তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, করোনা পজিটিভ। তত দিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। প্রথমদিকে করোনার সামান্যতম লক্ষণ দেখা দিলে করোনার টেস্টটা করে ফেলতে হবে। যদি পরীক্ষায় পজিটিভ আসে, তাহলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিতে হবে। সেটা বাসায় বসে নিতে পারেন, দরকার হলে হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেবেন। যদি অক্সিজেনের লেবেল ৯৩ এর নিচে নেমে যায়, তখনই যদি রোগী হাসপাতালে চলে আসেন, তাহলে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা পাওয়াটা সম্ভব। তাহলে মৃত্যুর হারটা অনেক কমে যাবে।’
করোনার সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকা দেওয়ার হার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে করোনার ঊর্ধ্বগতি চলছিল। মার্চ মাস থেকে করোনার সংক্রমণ অনেকগুণ বেড়ে যায়। মার্চের শেষ সপ্তাহে যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারা ধীরে ধীরে জটিল পরিণতিতে যাচ্ছে। কাজেই দুই সপ্তাহ আগে সরকারি যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তার প্রভাব দেখতে পাব আগামী সপ্তাহে। সংক্রমণটা স্থিতিশীল হয়ে আসবে। আর এখন যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের যে প্রভাব তা আমরা দেখতে পাব দু’সপ্তাহ পরে। তখন করোনার সংক্রমণটা ধীরে ধীরে নামতে শুরু করতে পারে। আর মৃত্যুর সংখ্যার প্রভাব পড়বে আরও দু’সপ্তাহ পরে। সে পর্যন্ত মৃত্যুর হার বাড়তে পারে। করোনার সংক্রমণটা স্থিতিশীল হচ্ছে বলে ধারণা করছি। এর কিছু কিছু লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। শনাক্তের হার ২০ এর কাছাকাছি থাকছে।’
করোনায় মৃত্যুর হার কিছুটা বাড়তে পারে বলে মনে করেন মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘লকডাউন কার্যকরের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে হয়তো করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে আসতে পারে। এই কমাটা হবে খুব ধীরে। সামনে দুটো ঈদ আছে, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সময়। দুটো ঈদ পার হয়ে গেলে হয়তো সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমতে থাকবে। তবে টিকা নেওয়ার হার সন্তোষজনক নয়।’