একটা সংগীত অনুষ্ঠান কোনো কারণে স্থগিত বা বন্ধ হয়ে গেলে ঠিক কতটুকু বিচলিত হওয়া সংগত?
দেশে তো আর আর্থসামাজিক সমস্যার অভাব নেই। বাংলাদেশে নানা বিষয়ে অর্থনৈতিক বিকাশে আমরা যেমন গর্ব অনুভব করি, আবার অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ যে রয়ে গেছে, সে কথাও অস্বীকার করা যাবে না।
সে কথা ঠিক, তবে ইংরেজিতে একটা কথা আছে, তার ভাবার্থ দাঁড়ায়, শুধু ক্ষুন্নিবৃত্তিই মানুষের জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়।
আমাদের প্রতিদিনের জীবনে শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার স্থান কোথায়—এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। আমি নিজে দীর্ঘকাল সংগীতচর্চা ও সংগীত শিক্ষণে জড়িত, সংস্কৃতিচর্চা মানুষের মনকে কতখানি বিকশিত করে, সেটা আমি নিজের চোখে গত অর্ধশতাব্দী ধরে দেখে এসেছি।
সে জন্যই সম্প্রতি উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলন আয়োজন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে শুনে এই সুদূর মেলবোর্নে বসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেলবোর্নে আমি আর আমার স্ত্রী কল্পনা আনাম এসেছি গানওয়ালা বলে এক বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক সংস্থার নিমন্ত্রণে। এখানে আমরা দুজনে গান গাইলাম কয়েক শ বাঙালি দর্শক-শ্রোতার সামনে, মনটা ভরে গেল। আরেকবার অনুভব করলাম, বাঙালির সংস্কৃতি আমাদের কত বড় সম্পদ।
আমার জীবনের সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক কত গভীর, সে কথা অনেকেই কমবেশি জানেন। সেই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে আমি বলতে পারি, আমাদের দেশে শুদ্ধ সংগীতচর্চায় উচ্চাঙ্গসংগীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিজে নজরুলসংগীতের পাশাপাশি কৈশোর থেকেই একনিষ্ঠভাবে উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চা করে এসেছি। সত্যি কথা বলতে কি, উচ্চাঙ্গসংগীতে ভালো অধিকার না থাকলে নজরুলসংগীতচর্চা ভালোভাবে সম্ভব নয়।
এ কারণেই গত কয়েক বছর উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনের আয়োজনে আমি অত্যন্ত আশান্বিত ও আনন্দিত হয়েছি। আমরা যারা দেশে শুদ্ধ সংগীতের চর্চা করি, তারা একটা বড় অন্তরায় সম্বন্ধে খুবই সচেতন—সেটা হলো দেশে সমঝদার শ্রোতার অভাব। অথচ কয়েক বছরে এই উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলন দেখিয়ে দিল যে সদুদ্দেশ্য, সাংগঠনিক নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাস থাকলে যেটা আর দশজনের কাছে অসম্ভব মনে হয়, সেই অসাধ্যসাধনও সম্ভব।
না হলে ১০ বছর আগে কেউ যদি বলত যে ঢাকার সারা রাত উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনে স্টেডিয়াম-ভর্তি লোক বসে সেই অনুষ্ঠান শুনবে, সে কথা কি কেউ বিশ্বাস করত? আমার সবচেয়ে যেটা ভালো লাগে, সেটা হলো কত তরুণ মুখ আমি সেই সম্মেলনে দেখি, তখন ভবিষ্যতে দেশে সংস্কৃতিচর্চা সম্বন্ধে আরেকটু ভরসা পাই।
লোক হবে নাই বা কেন? এমনকি যারা সচরাচর খুব একটা উচ্চাঙ্গসংগীত শোনেন না, তাঁরাও এ কথাটা বোঝেন যে উপমহাদেশের কিংবদন্তি যেসব উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পীর অপূর্ব সংগীত পরিবেশনা দর্শকেরা সরাসরি উপভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন, এ এক দুর্লভ, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!
এভাবে যে আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গসংগীত সাধারণ মানুষকে অনেকটা কাছাকাছি টানতে পেরেছে, সেটা এক বিশাল অর্জন। ভাবলেই আমার আনন্দ হয়। এভাবে ধীরে ধীরে শুদ্ধ সংগীত সমঝদারির হাত ধরে শুদ্ধ রুচির মানুষের সংখ্যা আরও বাড়ছে, এর চেয়ে বড় সাংস্কৃতিক অর্জন আর কী হতে পারে?
তবে কাজ সবে শুরু হয়েছে, আরও অনেক কাজ এখনো বাকি। এর মধ্যে কোনো রকমের বিরতি হলেই মহাবিপদ। সাধারণ মানুষ সবে উচ্চাঙ্গসংগীতের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছে, হয়তো একটু-আধটু ভালোও লাগছে, এই সময়ে এ অনুষ্ঠান যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শুদ্ধ সংগীতকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছে দেওয়ার এই সৎ প্রচেষ্টার মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
ঠিক কী কারণে এ অনুষ্ঠান আয়োজনে বিপত্তি ঘটেছে আমার জানা নেই, সেই বিতর্কে আমি জড়াতেও চাই না। দীর্ঘকাল ধরে আমি সংগীত চর্চা করছি, আমার দেশের সংস্কৃতির সাধ্যমতো সেবা করেছি, সেই জায়গাটা থেকে দাঁড়িয়ে আমি আকুল আবেদন জানাই, সব প্রতিবন্ধকতার অবসান হোক, সব বিপত্তি দূর হোক।
উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পীদের অপূর্ব পরিবেশনায় ঢাকার শীতের রজনী মুখরিত হয়ে উঠুক, টগবগে তরুণের পদচারণে উত্সব অঙ্গন জেগে উঠুক—দেশে ধীরে ধীরে শুদ্ধ সংগীত চর্চা ও তার সমঝদারি ছড়িয়ে যাক।
খায়রুল আনাম শাকিল: নজরুলসংগীতশিল্পী।